আপেল সিডার ভিনেগার কি ?
আপেল সিডার ভিনেগার উইথ মাদার আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের নিরলস প্রচারনায় ২০১৮ সাল থেকে এটি পরিচিতি লাভ করে। এখন মোটামুটি আমরা সবাই এটি সম্পর্কে জানি। আজকে আরও ভালোভাবে, বিস্তারিত জেনে নিব। এই তরল আজীবন সুস্থ থাকতে আবশ্যিক সহযোগী এক খাবার।
এটি আপেলের রস থেকে তৈরি ভিনেগার যা দুইবার গাঁজানো হয়। প্রথমত, আপেলের রস আপেল সিডারে গাঁজন করা হয়। তারপরে, আপেল সিডারকে আপেল সিডার ভিনেগারে গাঁজন করা হয়। এই দ্বিগুণ গাঁজন আপেলের রসের প্রাকৃতিক শর্করাকে প্রথমে অ্যালকোহলে এবং তারপরে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে ভেঙে দেয়। অ্যাসিটিক এসিড ছাড়াও, এতে আছে ভিটামিন, খনিজ, সাইট্রিক এসিড, ম্যালিক এসিড, এমাইনো এসিড, দ্রবণীয় ফাইবার, লাইভ এনজাইম এবং পলিফেনল (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) রয়েছে। এটিতে যেমন লাইভ ইস্ট ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক, এটিতে চমৎকার প্রোবায়োটিক গুণাবলীও রয়েছে।
আপেল সিডার ভিনেগার কেন খাবেন ?
সারা দিনে অল্প বিস্তর, সন্ধ্যায় ভিড় লেগে যায় ফার্মেসিতে। মনে হয় বাংলাদেশের সব মানুষ গ্যাসের সমস্যায় ভুগছেন। বিড়ি, সিগারেট কেনার মত গুরুত্ব সহকারে কিনে গ্যাসের ঔষধ। গ্যাসের ট্যাবলেট কতরকম সমস্যা তৈরি করতে পারে তা নিয়ে সতর্ক করেন ডাক্তারেরা। কিন্ত কে শোনে কার কথা ! পেট ভর্তি গ্যাস নিয়ে তো আর ভালো থাকা যায় না।
শিশুদের পাকস্থলিতে খাবার হজমকারি প্রচুর এসিড, এনজাইম নিঃসৃত হয়। একারনে শিশুরা সারাদিন খেতে পারে কিন্ত হজমে সমস্যা হয় না। আমরা যতই বড় হতে থাকি ততই এই এসিড নিঃসরণের পরিমান কমতে থাকে। কথায় আছে পেট ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। কথাটা এখন এটা সাস্থ্য গবেষণায় প্রমানিত। পাকস্থলিকে বলা হচ্ছে সুস্থ থাকা এবং অসুস্থ হওয়ার কেন্দ্র। অর্থাৎ পাকস্থলি ভালো থাকলে আমরা সুস্থ থাকব, ভালো না থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়ব।
এখানে আপেল সিডার ভিনেগার দেয় ন্যাচারাল সমাধান। এটা নিয়মিত খেলে পেটে এসিডের পরিবেশ ঠিক থাকে। এনজাইমের জোগান দেয়, প্রবায়োটিক এর অভাব পুরনে সহায়তা করে। কতটা উপকারী এই তরল পানীয়, জানলে অবাক হয়ে যাবেন। আজ থেকে আপনি খাওয়া শুরু করবেন। আজীবন খাবেন সুস্থতার নিমিত্তে।
আপেল সিডার ভিনেগার এর উপকারিতা
১. আপেল সিডার ভিনেগার খেলে ওজন কমে। কে বলেছে, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির। আসলে সারা বিশ্ব ব্যাপি হেলথ এক্সপার্ট গন এটা সাজেসট করেন ওজন কমাতে। এখন এটা পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত। সেরা ফলাফল পেতে অবশ্যই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। হেলদি খাবার, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি বিষয় মেনে চলার পাশাপাশি এই তরল পানীয় গ্রহণ করলে এটি বিএমআর (বডি মেটাবলিক রেট) বাড়িয়ে ওজন কমাতে ভূমিকা রাখবে। দ্রুত ওজন কমাতে আমরা আপনাদের তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে বলি।
২. টাইপ- ২ ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য আপেল সিডার ভিনেগার খুবই উপকারি। গবেষণায় দেখা গেছে, রাতে ঘুমানোর আগে দুই টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার খেলে, সকালে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ার গতি কমবে চার শতাংশ। যাদের ডায়াবেটিস নেই, তারাও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ ভিনেগার খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তবে যারা ইতোমধ্যে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন, তারা অবশ্যই হেলদি লাইফ স্টাইল অনুসরণ করবেন। আজীবন ডায়াবেটিকস মুক্ত থাকতে লেখাটি পড়ুন।
৩. এই তরল পানীয় রক্তের কোলেস্টেরল এবং উচ্চরক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যদিও নতুন গবেষণা গুলো কোলেস্টেরল নিয়ে ভিন্ন কথা বলছে। হাই কোলেস্টেরল বা হাই ব্লাডপ্রেশার থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে হৃদযন্ত্র ভালো থাকে। হেলদি লাইফ স্টাইল অনুসরনে কোলেস্টেরল কোন বিপদ নয়।
৪. যাদের হজমের সমস্যা আছে তারা খাবার খাওয়ার আগে বা পরে কুসুম গরম পানিতে এক/দুই চামচ আপেল সিডার ভিনেগার খেলে উপকার পাবেন। কুসুম গরম পানি না পেলে নরমাল পানিতেও খেতে পারেন। খাবার হজমের জন্য যে এনজাইম বা এসিড প্রয়োজন হয় এটি সেসব এনজাইম এবং এসিডের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার দ্রুত ও ভালোভাবে হজম হয়। বিধায় পেট ফুলে যায় না, পেটে গ্যাস হয় না। পেটের গোলমালে এই পানীয়কে নিয়মিত খাবার হিসেবে নিন।
৫. ফার্মেন্টেড/গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়ার কারণে এটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য। এ কারণে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের পরিমাণ কমায় এটি। শরীরে ইনফ্লামেসন কমায়।
৬. একটা ছোট বোতল নিন। অর্ধেক পানি নিন এবং অর্ধেক ভিনেগার দ্বারা পূর্ণ করুন বোতল। হয়ে গেল ন্যাচারাল সেভিং লোশন। সেভের পরে মাখলে দারুন এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করবে।
জীবনে কত টাকার প্রয়োজন ? টাকাকে কিভাবে কাজে লাগাবেন।
৭. গোসলের পানিতে মিশিয়ে নিন, দারুন জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করবে।
৮. দুই চামচ ভিনেগার নিন, গ্লাসে ঢালুন। এরপর এতে এক চা চামচ বেকিং ছেড়ে দিন। ফেনা উঠে গ্লাস ভরে উঠবে। ফেনা উঠা বন্ধ হলে এতে পানি ঢালুন ২৫০-৩০০ মিলি পরিমান। চামচ দিয়ে নেড়ে খেয়ে নিন। এটি বডিকে এলকালাইন করবে। ডাঃ মার্ক সার্কাস এটি গবেষণা করে আমাদের জন্য নিবেদন করেছেন।
৯. ওজন কমানোর জার্নিতে মিষ্টি খাবারের ক্রাভিংস দূর করতে পারে ভিনেগার। খুব মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে করলে কাপে এক টেবিল চামচ ভিনেগার নিন এরপর পানি দিয়ে কাপ পূর্ণ করুন। ধীরে ধীরে চায়ের মত করে খান। মিষ্টি খাবারের ইচ্ছা দূর হয়ে যাবে।
১০. হেঁচকি উঠলে এক চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার খেয়ে ফেলুন। এর টক স্বাদ হেঁচকি বন্ধ করবে। অতিরিক্ত উত্তেজিত স্নায়ু হেঁচকির জন্য দায়ী। তাই আপেল সিডার খেয়ে নিয়ে গুডবাই জানান হেঁচকিকে।
১১. গলাটা খুব খুসখুস করছে? তাহলে আপেল সিডার ভিনেগারকে আপনার সেবায় লাগিয়ে দিন। ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়াকেও প্রতিরোধ করবে এটি। কারণ অ্যাসিডযুক্ত পরিবেশে জীবাণুগুলো টিকতে পারে না। ১/৪ কাপ কুসুম গরম পানিতে ১/৪ কাপ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে এক ঘণ্টা পর পর কুলকুচা করলে উপশম পাওয়া যাবে।
আপেল সিডার ভিনেগার দাম কত
এই সুখাদ্যের দাম নিয়ে আমরা বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছি। সেই সাথে প্রডাক্ট টি অরিজিনাল কি না তা নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা সৌদিতে ১ লিটারের একটি বোতল ৬০০- ৭০০ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। কিন্ত বাংলাদেশে !! ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির বিক্রি করেন ১৯৯০ টাকায়, অন্য ডাক্তাররাও অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন। বাজারে দোকানে বেশ কম দামে পাওয়া যায়। কিন্ত ভেজালের ভয় আছে।
আপেল সিডার ভিনেগার কোনটা ভালো
সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং নির্ভরযোগ্য ব্রান্ড হচ্ছে ‘ Bragg aple cider vinegar’। কিন্ত বাংলাদেশে ভেজালের ভিড়ে এই ভিনেগার ইজ্জত হারিয়েছে। আমি এটা নিয়মিত খাই, ছবিতে যেটা দেখছেন। এর আমদানিকারক ‘ Discovery Bangladesh, ভিনেগার টি আমার কাছে বেশ ভালো মনে হয়। আর যেহেতু অন্য কেউ এটা আমদানি করে না, তাই নকল হওয়ার সুযোগ নেই।
আপেল সিডার ভিনেগার নিয়ে মুল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন ডাঃ এরিক বারগ।
আসল আপেল সিডার ভিনেগার চেনার উপায়
খাঁটি ভিনেগার পানিতে মিশিয়ে যখন খাবেন, তখন টক ঝাঁঝালো স্বাদ অনুভুত হবে। ফ্রেস ভিনেগারের মধ্যে বেকিং সোডা দিলে দারুন ফেনা উঠবে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার উপায় ল্যাবে টেস্ট করা।
আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম
বিভিন্ন ভাবে এটা খাওয়া যেতে পারে। রান্নায় কোন তরকারিতে দিতে পারেন। সালাদ ড্রেসিং এ দিতে পারেন। অল্প গরম একগ্লাস পানির সাথে ১/২ চামচ মিশিয়ে খেতে পারেন। কুসুম গরম পানি না থাকলে ঠাণ্ডা পানির সাথে মিশিয়েও খেতে পারেন। চিয়া সিড ভিজিয়ে রেখে এর সাথে ভিনেগার মিশাতে পারেন। একবাটি রান্না করা মসুর ডাল নিয়ে তাতে ১/২ চামচ ভিনেগার মিশিয়ে খেতে পারেন। বেকিং সোডার সাথে খেতে পারেন।
আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার সময়
খাবার গ্রহনের ১০ মিনিট আগে বা পরে খেতে পারেন। বেকিং সোডার সাথে খেলে অবশ্যই খালি পেটে খাবেন। অথবা খাবার গ্রহনের দেড় ঘণ্টা পরে খাবেন। যাদের হজম ক্ষমতা কম তারা দিনের যে কোন সময় খেতে পারেন। ওজন কমাতে দিনে তিনবার খাবেন।
আপেল সিডার ভিনেগার কতদিন খাওয়া যায়
সারা জীবন খাবেন। কোন সমস্যা নেই, অবশ্যই পরিমানমত খাবেন। কোন কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। যারা অলরেডি আলসারে আক্রান্ত তারা প্রথমে আলসার দূর করবেন এরপর খাবেন। কারও যদি খাওয়ার পর শরীর ঘামে, অস্থির লাগে তারা খাবেন না। এক্ষেত্রে ধরে নিতে পারেন আপনি অসুস্থ, অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
সেলিম হোসেন – ২২/১১/২০২৪ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.