ছোলা বুটের উপকারিতা: ঘোড়ার খাদ্য থেকে শতায়ু মানুষের গোপন রহস্য
আমাদের দেশে ছোলা বা বুট একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। কিন্তু আপনি কি জানেন, প্রাচীনকালে যখন পাকা রাস্তাঘাট বা আধুনিক যানবাহন ছিল না, তখন ভারী মালামাল টানা ঘোড়ার প্রধান খাদ্য ছিল এই ছোলা? ঘোড়াকে শক্তি, সুস্থতা ও দীর্ঘ পথ চলার জোগান দিত এই শস্য দানা।
এখনকার দিনে, পৃথিবীর যে পাঁচটি অঞ্চলকে ব্লু জোনস (Blue Zones) বলা হয়—যেখানে মানুষ ৯০ থেকে ১০০ বছর বা তার বেশি বাঁচেন—তাদের প্রধান খাদ্যশস্যের মধ্যে অন্যতম হলো এই ছোলা। এই পাঁচটি অঞ্চল হলো: জাপানের ওকিনাওয়া, কোস্টারিকার নিকোয়া, ইতালি সারদিনিয়া, গ্রিসের ইকারিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিনডা। তাদের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের অন্যতম রহস্য এই শস্য দানা।
ভিডিও দেখুন – কিভাবে এই শস্য দানা স্প্রাউটেড করবেন।

ছোলা খাওয়ার চার উপায়
ছোলা বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়, এবং প্রতিটি উপায়েরই নিজস্ব পুষ্টিগুণ ও সুবিধা রয়েছে। আপনি মূলত চার উপায়ে ছোলা খেতে পারেন: শুকনো ভাজা, স্প্রাউটেড (অঙ্কুরিত), কাঁচা ও সিদ্ধ।
১. শুকনো ভাজা
রাস্তাঘাটে হকাররা যে শুকনো ভাজা ছোলা বিক্রি করেন, সেটি সহজেই কিনে খাওয়া যায়।
-
উপকারিতা: এটি অন্যান্য উপায়ে খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি (এনার্জি) সরবরাহ করে। এতে প্রোটিন বেশি, ফ্যাট কম এবং ফাইবারের পরিমাণও সবচেয়ে বেশি থাকে।
-
পরামর্শ: বিকেলের নাস্তায় অল্প পরিমাণে কিনে অনায়াসে খেতে পারেন।
২. স্প্রাউটেড বা অঙ্কুরিত
অঙ্কুরিত ছোলা (স্প্রাউটেড) অত্যন্ত পুষ্টিকর, তবে হজম শক্তি ভালো থাকা জরুরি।
-
উপকারিতা: কাঁচা ছোলার চেয়ে এতে আর্দ্রতা বা ময়েসচার থাকে ৭ গুণ বেশি। এটি প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকে, যা অন্য উপায়ে খেলে পাওয়া যায় না। প্রোটিনের পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বেশি থাকে। শর্করা ও ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে।
-
পরামর্শ: এটি সালাদের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
৩. কাঁচা (ভেজানো)
যদি আপনার হজম শক্তি ভালো থাকে, তবে সীমিত পরিমাণে কাঁচা ছোলা খেতে পারেন।
-
উপকারিতা: পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। অল্প কয়েকটি দানা চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য একটি ভালো অভ্যাস।
৪. সিদ্ধ (সালাদ হিসেবে সেরা)
পুষ্টি পেতে হলে ভুনা ছোলা এড়িয়ে চলাই ভালো। সিদ্ধ ছোলা সালাদ হিসেবে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী।
-
প্রস্তুতি: ছোলা থেকে কেমিক্যাল দূর করতে এবং হজমের উপযোগী করতে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর ভালোভাবে সময় নিয়ে সিদ্ধ করুন।
-
সালাদ তৈরি: সিদ্ধ ছোলার সঙ্গে টমেটো, শসা, চাটমশলা এবং অল্প অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল দিয়ে সালাদ তৈরি করুন। স্বাস্থ্যের জন্য এটি অনেক উপকারী। এছাড়া এর সঙ্গে টক দই মিশিয়েও নিতে পারেন।
পরিমাণ: কোনো খাবারই অতিরিক্ত গ্রহণ করা ভালো নয়। একজন সুস্থ ব্যক্তি প্রতিদিন ২৫-৩০ গ্রাম ছোলা খেতে পারেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
একমাসে ১০ কেজি ওজন কমাবেন কিভাবে।

ছোলা খাওয়ার ১০টি স্বাস্থ্য উপকারিতা
ছোলা হলো একটি প্ল্যান্ট-বেজড প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, যা অসংখ্য স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে:
১. হজম ক্ষমতার উন্নতি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর: এতে প্রচুর ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমায় এবং শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান বের করে দিতে সাহায্য করে।
২. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত ছোলা খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ছোলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। এর আঁশ রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায় এবং গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা এটি খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।
৪. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: এটি শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। যাদের হাই কোলেস্টেরল আছে, তারা প্রোটিনের চাহিদা পূরণে নিশ্চিন্তে ছোলা খেতে পারেন।
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ: এটি কম ক্যালরিযুক্ত এবং ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৬. ত্বক ও চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি: এটি ভিটামিনসমৃদ্ধ হওয়ায় ত্বক উজ্জ্বল করে এবং চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
৭. অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ: এতে প্রচুর আয়রন আছে। এটি দেহে লোহিত রক্ত কণিকার উৎপাদন বাড়িয়ে রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) প্রতিরোধ করে।
৮. হৃদ্রোগের ঝুঁকি হ্রাস: শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
৯. দৃষ্টিশক্তি ও হাড়ের স্বাস্থ্য: নিয়মিত ছোলা খেলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। এতে থাকা ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্ক হাড়ের মিনারেল ডেনসিটি উন্নত করে অস্টিওপোরেসিসের মতো বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ দূর করে।
১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রদাহ হ্রাস: এতে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং বিভিন্ন উপাদান ক্যান্সার ও টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করে। সালফার নামক খাদ্য উপাদান জ্বালাপোড়া (প্রদাহ) দূর করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও ছোলায় ভিটামিন বি১, বি২, বি৬ এবং প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও কপার থাকে।
জেনে নিন – কিভাবে আজীবন ঔষধ ছাড়া সুস্থ থাকবেন।

ছোলা খেতে সাবধানতা
সুস্থ জীবন পেতে হলে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে:
-
কিডনি সমস্যা: ছোলায় প্রচুর পটাশিয়াম থাকে। তাই কিডনিজনিত সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে।
-
পেটে ব্যথা: যদি আপনার পেটে ব্যথা বা হজমের সমস্যা থাকে, তবে এই সময়ে ছোলা খাওয়া উচিত নয়।
-
কৌটা বা টিনজাত ছোলা: দোকান থেকে কৌটা বা টিনজাত কোনো ছোলা কিনবেন না। এগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশানো থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সব সময় তাজা ছোলা ব্যবহার করুন।
রেফারেন্স
-
USDA National Nutrient Database: “Black Beans, Boiled, Without Salt”
-
American Heart Association: “The Skinny on Fats”
-
Office of Dietary Supplements: “Nutrient Recommendations: Dietary Reference Intakes (DRI)”
-
Harvard School of Public Health: Fiber: “Fiber”
-
National Institutes of Health Office of Dietary Supplements: “Vitamin C”
-
USDA National Nutrient Database: “Chickpeas (garbanzo beans, bengal gram), mature”
যদি আপনার কোনো বন্ধু দুর্বলতা বা কম শক্তি অনুভব করেন, তাকে পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
সেলিম হোসেন – ০৮-২৬-২০২৪ ইং ছবি উৎস: প্রতীকী ছবিগুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া।

