হজম শক্তি বৃদ্ধির উপায়: প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ থাকুন

সাধারণ অর্থে হজম একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় মুখে গ্রহণ করা খাদ্য প্রথমে ছোট ছোট টুকরো হয়, তারপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এনজাইম দ্বারা তা শরীরে মিশে যাওয়ার উপযোগী হয়। এই জটিল কাজটি মুখ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত বিস্তৃত খাদ্যনালী এবং এর সাথে যুক্ত কিছু অঙ্গ মিলে সম্পন্ন করে।

তবে আধুনিক জীবনযাত্রা এবং ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের অনেকেরই হজম শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। হজম শক্তি প্রাকৃতিকভাবে বাড়ানোর কার্যকরী উপায়গুলি নিচে আলোচনা করা হলো।

বদহজম বা দুর্বল হজম শক্তির প্রধান কারণসমূহ

হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার মূল কারণগুলি জানা থাকলে তা এড়িয়ে চলা সহজ হয়।

১. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও রুটিন

• ভাজাপোড়া, শুষ্ক খাবার এবং বাজে তেল-চর্বিতে তৈরি খাবার গ্রহণ।

• গরুর মাংস বা এজাতীয় ভারী মাংস অতিরিক্ত খাওয়া।

• খাবার দ্রুত গেলা, ভালোভাবে না চিবানো।

• খাবার খাওয়ার সময় একদম পেট ভর্তি করে ফেলা।

• অতিরিক্ত ঝাল খাওয়া।

• গভীর রাতে বা খুব ভোরে একসঙ্গে অনেক বেশি খাবার খাওয়া।

২. মানসিক ও জীবনযাত্রার চাপ

• অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদ।

• নিয়মিত রাত জেগে ডিভাইস চালানো বা ডিউটি করা।

৩. স্বাস্থ্যগত কারণ

• প্যানক্রিয়াসে (Pancreas) সংক্রমণ (ইনফেকশন) হলে খাবার সঠিকভাবে হজম হয় না।

• ডায়াবেটিস থাকলে বা রক্তে চিনির মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে পাকস্থলীতে খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণ দুর্বল হয়ে যায়।

• নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ যেমন— মানসিক রোগের বা কেমোথেরাপির ওষুধ সেবন করলে পাকস্থলীর শক্তি কমে যায়।

৪. নেশা দ্রব্য ও উদ্দীপক গ্রহণ

• মাদকদ্রব্য, ধূমপান, অতিরিক্ত চা-কফি, পান, সুপারি, গুল, জর্দা ইত্যাদি হজমশক্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল করে।

আপেল সিডার ভিনেগার কেন প্রতিদিন খাবেন, জেনে নিন। 

দুর্বল হজম শক্তির ক্ষতিকর প্রভাব

যদি আপনার হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, তবে শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমনকি ওজন বেড়ে যাওয়াও এর অন্যতম লক্ষণ।

• ওজন বৃদ্ধি: কিছু না খেয়েও যদি ওজন বাড়তে থাকে, তবে বুঝবেন আপনার পরিপাক প্রক্রিয়ায় সমস্যা হচ্ছে।

• লিপিড প্রোফাইল বৃদ্ধি: লিপিড প্রোফাইল, ইউরিক এসিড, এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

প্রাকৃতিকভাবে হজম শক্তি বৃদ্ধির কার্যকরী উপায়

হজম ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কিছু প্রাকৃতিক উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে:

ক. পাকস্থলীতে অ্যাসিডের মাত্রা উন্নত করা

খাবারের সাথে অ্যাসিড যুক্ত করলে পাকস্থলীর অ্যাসিড লেভেল ভালো থাকে, যা খাদ্য হজমের জন্য জরুরি।

• লেবুর রস ও আপেল সিডার ভিনেগার (ACV): যাদের হজমের সমস্যা বেশি, তারা প্রতিবার খাবারের পরে দুই চামচ ভিনেগার বা লেবুর রস হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে খেতে পারেন।

• পানীয়: খাবারের সাথে পানি পান করা হজম ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই খাবার গ্রহণের এক ঘণ্টা পর পানি পান করুন। এই পানিতেও লেবুর রস বা আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিতে পারেন।

খ. খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা

• চিবিয়ে খাওয়া: খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে।

• সালাদ ও ফাইবার: খাবারের প্রথমে সালাদ খাবেন, এরপর শাকসবজি খাবেন। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ বা ফাইবার থাকে যা হজমে সাহায্য করে।

• সহজ পাচ্য খাবার: যাদের পেটে বেশি সমস্যা, তারা আপাতত মাছ, মাংস বাদ রাখবেন। প্রতিদিন ডিম খেতে পারেন। একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করলে প্রতিদিন ৪-৬টি ডিম খাওয়া যেতে পারে। ডিমের কুসুমে সবরকম পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান।

গ. আদার ব্যবহার

আদা পাকস্থলীতে খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিখ্যাত।

• এনজাইম উৎপাদন: খালি পেটে আদার রস পান করলে তা খাদ্য পরিপাকের এনজাইমের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে।

• উপকারিতা: এটি পেট ফাঁপা, বদহজম এবং অন্যান্য অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। আদা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যৌগে ভরপুর, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

ঘ. ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (বিরতিমূলক উপবাস)

উপবাস বা ফাস্টিং হজম প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার একটি খুবই কার্যকর উপায়।

• ফাস্টিং: কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা ফাস্টিং করুন। ২০ ঘণ্টা করতে পারলে আরও ভালো।

• সুবিধা: ফাস্টিং করলে শরীরে স্টেম সেল তৈরি হয়। এই স্টেম সেল ক্ষতিগ্রস্ত পাকস্থলীকে সারিয়ে তোলে, যা খাদ্য ভেঙে ফেলার ক্ষমতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

পড়ুন বিস্তারিত – ফাসটিং কিভাবে করবেন। 

হজম শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠুন এবং আপনার শরীরের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায়াম করুন।

• ব্যায়াম: হাঁটতে পারেন, জগিং করতে পারেন বা দৌড়াতে পারেন। সব ধরনের ব্যায়ামই পাকস্থলীর উন্নতি ঘটায়, যার ফলে শরীর খাবারকে সঠিকভাবে পরিপাক করতে পারে। যোগ ব্যায়ামও করতে পারেন।

ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনের এক গবেষণা অনুযায়ী, ৭৫ ভাগ মানুষ হজমজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। আমরা আশা করি, এই উপায়গুলি অনুসরণ করে আপনিও এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন এবং সুস্থ থাকবেন।

কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম আছে ভিডিওতে দেখে নিন।

উপসংহার আপনার এই মূল্যবান পোস্টটি অন্যদেরকেও শেয়ার করুন, সবার কাজে লাগবে।

সেলিম হোসেন – তাং ২৫/০৮/২০২৪ ইং ছবি গুলো প্রতীকী

Reference: Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.