সহিংস মুভিতে আসক্ত: তরুণ-তরুণীরা কেন বিপদে?
প্রচণ্ড গোলাগুলি, বোমাবাজি, খুন, রক্ত এবং চরম উত্তেজনা—এসব উপাদানই অনেক সহিংস মুভি ও ভিডিও গেমের প্রধান আকর্ষণ। কিশোর, তরুণ ও তরুণীরা এই কাল্পনিক জগতে বুঁদ হয়ে যান, যা তাদের মনে এক সাময়িক রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। কিন্তু বিনোদনের নামে এই সহিংসতায় আসক্তি তাদের মনোজগতে কী পরিবর্তন আনছে এবং বাস্তব জীবনে এর কী ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে, তা আমাদের জানা প্রয়োজন।
বিনোদন নাকি মানসিক ঝুঁকি?
সহিংস মুভি বা ভিডিও গেমসে দেখানো কার্যকলাপ সাময়িকভাবে উত্তেজনা দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায় এবং সুস্থ মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। মানুষ কেন সহিংস হয় এবং কীভাবে সহিংস হয়ে ওঠে, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানে বহু গবেষণা হয়েছে।

সহিংসতার উৎস: সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব
মানুষ জন্মগতভাবে সহিংস নয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন তার চারপাশে সহিংস ঘটনা অবলোকন করে (সেটা মুভি, গেমস বা বাস্তবতাই হোক), তখন অবচেতন মনে তার প্রভাব পড়ে।
কানাডিয়ান-আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট বান্দুরার (Albert Bandura) প্রবর্তিত ‘সোশ্যাল লার্নিং থিওরি’ (Social Learning Theory) এই ধারণাকে সমর্থন করে। এই তত্ত্ব অনুসারে, শিশু-কিশোরেরা অন্যদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে শেখে এবং সেই আচরণগুলো অনুকরণের প্রবণতা তৈরি হয়।
বোবো ডল পরীক্ষা (Bobo Doll Experiment): ষাটের দশকে বান্দুরার পরিচালিত ‘বোবো ডল এক্সপেরিমেন্ট’ প্রমাণ করে যে, যে দলের শিশুরা একজন মডেলকে একটি পুতুলকে (বোবো ডল) সহিংসভাবে আঘাত করতে দেখেছে, তারা অন্য দলের শিশুদের তুলনায় আক্রমণাত্মক আচরণ বেশি দেখিয়েছে। অর্থাৎ, সিনেমা বা ভিডিও গেমসে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে সহিংস উপায়ে অন্যায় দমন করতে বা পুরস্কৃত হতে দেখলে, তরুণদের মধ্যেও অবচেতনভাবে সেই আচরণ অনুকরণের প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
জামাইদের আচরন কি সব দেশে একই রকম ? জামাই কাণ্ডে ভাইরাল নিউজ।

সহিংস আসক্তির ৫টি মারাত্মক মানসিক ক্ষতি
সহিংস মুভি বা ভিডিও গেম নিয়মিত দেখার ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিম্নরূপ:
১. সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া (Desensitization)
ভার্চ্যুয়াল জগতে বারবার সহিংসতা দেখলে শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নিষ্ঠুরতা বিষয়ে নির্লিপ্ততা বা সংবেদনশীলতা কমে যেতে পারে। তাদের কাছে বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া সহিংস আচরণও স্বাভাবিক মনে হতে পারে। অন্যের দুঃখকষ্টে সমব্যথী হওয়ার মানবিক গুণটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
২. ‘মিন ওয়ার্ল্ড সিনড্রোম’ (Mean World Syndrome)
অনবরত সহিংস দৃশ্য বা কন্টেন্টের সংস্পর্শ অল্প বয়সীদের মধ্যে পৃথিবী সম্পর্কে একটি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, মানুষ মাত্রই সহিংস, বিশ্বাসঘাতক এবং পৃথিবীটা একটি খারাপ জায়গা। এর ফলে তাদের মনে ভয়, সন্দেহ ও অন্যদের প্রতি অনাস্থা মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি
গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংস মিডিয়াতে আসক্ত হলে উদ্বেগ (Anxiety), বিষণ্নতা (Depression) ও মানসিক চাপ (Stress) বাড়ে। সহিংসতার গ্রাফিক চিত্র তরুণদের মস্তিষ্কে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যা অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ এবং ঘুমের সমস্যার কারণ হতে পারে। দীর্ঘদিন এমনটা চললে তা গুরুতর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে।
৪. আগ্রাসী আচরণ ও অনুকরণের প্রবণতা
সহিংস মুভি ও গেমসে আক্রমণাত্মক চিন্তা ও মনোভাব বাড়িয়ে তুলতে পারে। যখন তারা দেখে যে সহিংসতার মাধ্যমে খুব সহজে এবং দ্রুত কোনো সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে বা কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরস্কৃত হচ্ছে, তখন তারা আক্রমণাত্মকভাবে কিছু আদায় করাকে সহজ পথ মনে করে। ফলে সামাজিক পরিস্থিতিতে আলোচনার পরিবর্তে তারা সহিংস উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
৫. সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
অতিরিক্ত সহিংসতা আসক্তির কারণে মমতা ও সহমর্মিতার অভাব দেখা দেয়, যা তরুণদের সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি এবং বজায় রাখতে বাধা তৈরি করে। আক্রমণাত্মক আচরণ ও অন্যের প্রতি অনাস্থার কারণে তারা ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং পারিবারিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নাটক সিনেমা দেখা নিয়ে ডঃ আহাম্মদ উল্লাহ কি বলছেন।

সমাধানের পথ: সচেতনতা ও যত্নের বিকল্প নেই
মনে রাখবেন, সবাই সহিংস মুভিতে আসক্ত হবে এমনটি নয়। এর প্রভাব নির্ভর করে ব্যক্তির মেজাজ, ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক পরিবেশ এবং সামাজিক অবস্থার ওপর। তবে এই বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং নিজের ভেতর পরিমিতিবোধ তৈরি করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
করণীয়:
- সময় নির্ধারণ: বিনোদনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করুন এবং সেই সময়ের বাইরে ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন।
- বিকল্প বিনোদন: সৃজনশীল ও মননশীল বিনোদন, যেমন বই পড়া, খেলাধুলা বা আউটডোর কার্যক্রমে মনোযোগ দিন।
- আলোচনা: অভিভাবকরা সন্তানের সাথে তাদের দেখা বা খেলা কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা করুন, যাতে তারা ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে।
- পেশাগত সাহায্য: যারা ইতিমধ্যেই সহিংস মুভি বা গেমে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়েছেন এবং নিজেরা বেরিয়ে আসতে পারছেন না, তারা দেরি না করে কাউন্সেলিং সেবা বা মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নিতে পারেন।
আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। সুস্থ বিনোদন জীবনকে সুন্দর করে তোলে, সহিংস আসক্তি নয়।
মুভি পাগল বন্ধুদের পোস্টটি শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – ১৮/১০/২০২৪ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া।

