ডায়াবেটিস নিরাময়: সচেতনতা ও সুস্থ জীবনযাত্রার মাধ্যমে মুক্তি
ডায়াবেটিস আমাদের সমাজে এক আতঙ্কের নাম। সারাজীবন ঔষধ খেতে হবে—এমন একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। তবে একটু সচেতন হলেই এই ভয়ানক রোগটি থেকে শুধু মুক্তি নয়, বরং একে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করে সুস্থ থাকা সম্ভব। কারণ, ডায়াবেটিস হলো মূলত একটি লাইফস্টাইলজনিত সমস্যা।
ডায়াবেটিসের (টাইপ ২) সাধারণ লক্ষণসমূহ
ডায়াবেটিসকে ভয়াবহ করে তোলে এর সাথে আসা অন্যান্য বড় রোগগুলোর ঝুঁকি। কিন্তু সঠিক সময়ে লক্ষণগুলো চিনতে পারলে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়া।
- অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করা।
- শরীরের ওজন হ্রাস পাওয়া।
- শরীরের কোনো ঘা বা ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া।
- অধিকতর তৃষ্ণা অনুভব করা।
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা।
- হাত-পা অসার বা ঝিনঝিন করা।
- ত্বক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
- শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক সংক্রমণ (ইনফেকশন) হওয়া।
পড়ুন – দ্রুত ওজন কমানোর সবচেয়ে সাস্থ্যকর উপায়।

ডায়াবেটিস কী? (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সহজ ব্যাখ্যা)
আমাদের বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস হলো টাইপ ২, যা মূলত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
যখন আমরা শর্করা জাতীয় খাবার খাই, তখন শরীরে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো শর্করার অণুগুলোকে রক্ত থেকে টেনে নিয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করানো। কোষ তখন এই শর্করা ব্যবহার করে শক্তি উৎপন্ন করে। ফলে রক্ত শর্করা মুক্ত থাকে।
কিন্তু যখন কোষগুলো ইনসুলিনকে ঠিকমতো সাড়া দেয় না (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স), তখন ইনসুলিন নিঃসৃত হলেও শর্করা কোষে প্রবেশ করতে পারে না। এই অতিরিক্ত শর্করা রক্তে থেকে যায়—সহজ কথায় এটাই ডায়াবেটিস টাইপ ২।
হু হু করে বাড়ছে কিডনি রোগী। আজীবন কিডনি ভালো রাখার উপায়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ: ঘুম ও সারকাডিয়ান রিদম
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঠিক করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ঘুমের ধরন ঠিক করা। আমাদের শরীরের হরমোনের একটি ছন্দ আছে, যাকে বলা হয় সারকাডিয়ান রিদম। এই রিদম আমাদের ঘুম এবং দৈনিক কার্যকলাপের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
- ঘুমের সময়: প্রতিদিন রাত ১০টার মধ্যে ঘুমাতে যান।
- ডেল্টা স্লিপ: রাত ২টা পর্যন্ত স্বপ্নবিহীন যে গভীর ঘুম হয়, চিকিৎসকের ভাষায় একে ‘ডেল্টা স্লিপ’ বলা হয়। এই সময়টি শরীরের পুনরুদ্ধার ও হরমোন ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
- হরমোনের ভারসাম্য: ঘুমের ধরন উলট-পালট হয়ে গেলে সারকাডিয়ান রিদমও বিপর্যস্ত হয়, যার ফলে হরমোনাল ইমব্যালেন্স তৈরি হয়। আপনি ঘুমের ধরন ঠিক না করে যতই চেষ্টা করুন না কেন, অন্যান্য হরমোনাল ইমব্যালেন্স বার বার ফিরে আসবে।
ভিডিও দেখুন – ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির বলছেন ” ডায়াবেটিস দূর করা অতি সহজ।”

খাদ্যাভ্যাস: কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ও আঁশযুক্ত খাবার
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন খাবার খেতে হবে, যা খেলে ইনসুলিন কম নিঃসৃত হয় বা যার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) কম।
যে খাবারগুলো খাবেন:
| খাবারের প্রকার | উদাহরণ | সুবিধা |
|---|---|---|
| কম GI ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার | ইলিশ মাছ, পাঙ্গাস মাছ, সামুদ্রিক মাছ (তৈলাক্ত মাছ), ডিম (কুসুম নরম রেখে ঘি দিয়ে পোঁচ), বাদাম, ফ্লাক্স সিড, পামকিন সিড, চিয়া সিড। | গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, ইনসুলিন কম নিঃসৃত হয়। |
| কমপ্লেক্স শর্করা (আঁশযুক্ত) | লাল চালের ভাত, যবের ছাতু, কালো চালের ভাত, কিনোয়া, বাকউইড। | ধীরে ধীরে হজম হয় ও শোষিত হয়, ফলে ইনসুলিন ধীরে নিঃসৃত হয় এবং ক্ষুধা কম লাগে। |
| ফল ও সবজি | গ্রিন আপেল, পীচ, ডুমুর, বেরি, কিউই, ব্রকলি, পালং শাক, মটরশুঁটি, ছোলা। | প্রচুর আঁশ ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। |
পড়ুন – আজীবন কিভাবে গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্ত থাকবেন, ঔষধ ছাড়াই।

যে সবজিগুলো পরিমাণে কম খাবেন:
যদিও সব ধরনের সবজিই খাওয়া যায়, তবে কিছু সবজি তাদের শর্করার পরিমাণের কারণে পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। যেমন: গাজর, মুলা, শালগম। মাঝারি সাইজের পাকা কলাও পরিমিত পরিমাণে খেতে পারেন, তবে তা যেন খুব বেশি পেকে না যায়।
ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট জটিলতা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
- কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে (রেটিনোপ্যাথি)।
- যৌন অক্ষমতা দেখা দেওয়া।
- পায়ে পচন বা গ্যাংগ্রিন সৃষ্টি হওয়া, যার ফলে পায়ের আঙুল বা পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।
আজীবন ঔষধ ছাড়াই সুস্থ থাকার লাইফস্টাইল।

সুস্থ থাকার লাইফস্টাইল: ব্রেইন ও গাট হেলথ
নতুন গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিসের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখন আমরা জানতে পারছি যে, আমাদের ব্রেইন শুধু মাথায় নয়, পেটেও আছে—এটি হলো আমাদের ‘গাঠ’ (Gut) বা অন্ত্র।
গাঠকে সুস্থ রাখার উপায়:
- প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার: গাঁটকে সুস্থ রাখতে কিমচি, সাওয়ার ক্রাউট, টক দই, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার খান।
- ভাল ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব: গাঁটের ভালো ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চাহিদা তৈরি করে। বিপরীতে, খারাপ ব্যাকটেরিয়া জাঙ্ক ফুড ও আনহেলদি খাবার খেতে প্ররোচনা দেয়।
আজীবন ঔষধ ছাড়াই সুস্থ থাকার জন্য এই লাইফস্টাইল পরিবর্তনগুলো অপরিহার্য। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবার জন্য শুভ কামনা।
ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারকে পোস্টটি শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – ৩০/০৭/২০২৪ ইং
তথ্যসূত্র: Dr. Eric Berg, Dr. Mujibul Haque, Dr. Jahangir Kabir, Dr. Mujibur Rahman, Dr. Mandell, Dr. Jason Faung, Dr. Sten Ekberg এবং বিভিন্ন মেডিকেল হেলথ জার্নাল। বি.দ্র.: পোস্টে ব্যবহৃত সকল ছবি প্রতীকী।









