আকুপাংচার চিকিৎসা কোথা থেকে এল
জুমার পূর্বের মুহূর্ত। সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ। হিমেল হাওয়ার সাথে সূর্যের আলো মিশে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। রাস্তায় একটি সাংকেতিক হর্ন বাজিয়ে এ্যাম্বুলেন্স ছুটে গেল। ভিতরে রোগী, জরুরী অবস্থা। গন্তব্য হাসপাতাল। উদ্দেশ্যে নিরাময় লাভ করা।
জরুরী অবস্থায় আমাদের কে মেডিসিনাল চিকিৎসা নিতে হয়। আর জরুরী না হলে অন্য চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে। হেলদি লাইফস্টাইল হতে পারে মেডিসিন। জরুরী না হলে ইদানিং কেউ কেউ আকুপাংচার চিকিৎসা নেন।
আকুপাংচার কি ? এটা কিভাবে কাজ করে ?
ন্যাচারালি বিদায় করুন গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কে

এই চিকিৎসা এসেছে চীন থেকে। প্রাচীন কালে চীনে উদ্ভিদের ভেষজ গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট নিয়ে গবেষণা করেন শেন নং। তিনি সম্রাট ফুয়ু নামে পরিচিত ছিলেন। তখনকার চীনে চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতি ছিল গাছ লতাপাতার ঔষধ। গরম শিক দিয়ে ছ্যাকা দেয়া এবং আকুপাংচার।
আমাদের শরীরে আছে ইমিউন সিস্টেম। এর সমস্ত রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে। এই সিস্টেমে গোলমাল হলেই আমরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হই। আধুনিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা রোগীর সমস্যা চিণ্হিত করেন। সেই অনুযায়ী ঔষধ দেন। রোগী ঔষধ খেয়ে অসুখ নিরাময়ের চেষ্টা করেন।
আকুপাংচারের কাজটাও তাই। কিন্ত এখানে ঔষধ খেতে হয় না। নার্ভকে উদ্দীপিত করে শরীরের ভেতরে কেমিক্যাল কে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেয়া হয়। এতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। এই কাজটা ঠিকঠাক মত করাটাই আকুপাংচারের কাজ। অনেকেই এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নিচু চোখে দেখেন। কিন্ত বিষয়টা তা নয়। ১৯৭৯ সালে হু আকুপাংচারকে চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
কম বয়সে কেন চুল পরে, বন্ধ করার উপায় কি

আকুপাংচার চিকিৎসা যেসব রোগে
১. হজম শক্তি বাড়াতে
ন্যাচারালি আমাদের হজম শক্তি কম বেশি আছে। যেমন আমার হজম শক্তি কম। কিন্ত আমাদের শারীরিক সুস্থতার মুল জায়গাটা হল, খাবার হজমের ক্ষমতা। আকুপাংচার বিভিন্ন গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অবস্থার ভালো উন্নতি করতে পারে। আকুপাংচার নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলিকে উদ্দীপিত করে। এই থেরাপিটি অন্ত্রের কাজের গতি বাড়াতে পারে। প্রদাহ কমাতে এবং পাচনতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
হজম স্বাস্থ্যের জন্য আকুপাংচার পেটের স্নায়ু তন্ত্রকে শক্তিশালী করে। যে সব এনজাইম হজমে সহায়ক সেগুলোকে স্নায়ুতন্ত্রে ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, আকুপাংচার চিকিৎসা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) রোগীদের জন্য ভালো কাজ করতে পারে। গ্যাস্ট্রোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD), এবং দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য, এই সমস্যাগুলি উপশম করে। আকুপাংচার শরীরে খাবারের পুষ্টি শোষণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, যে আইবিএস আক্রান্ত রোগীরা আকুপাংচার করেছেন, তারা মেডিক্যাল ডাক্তারদের চিকিৎসার তুলনায় আকুপাংচারে বেশি পরিমানে উপকৃত হয়েছেন। উপরন্তু, আকুপাংচার GERD রোগীদের মধ্যে অ্যাসিড রিফ্লাক্স পর্বের তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে পারে। এটি একটি কার্যকর পরিপূরক থেরাপি হিসেবে করে।
জামাতে নামাজ আদায়ের ফজিলত নিয়ে বৈজ্ঞানিক কথা

২. মাইগ্রেন উপশম জন্য আকুপাংচার
মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে প্রচলিত ঔষধ গুলো ভালো কাজ করে না। মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। মাইগ্রেন আক্রান্ত ব্যাক্তি খুব কষ্ট পান। এসব রোগীদের জন্য আকুপাংচার বিকল্প চিকিৎসা। মাইগ্রেন আক্রান্ত রোগীদের জন্য আকুপাংচার খুব ভালো কাজ করে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সমস্যায় এটি মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ উন্নত করে। প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হরমোন এন্ডরফিন নিঃসরণে সাহায্য করে। নিয়মিত আকুপাংচার সেশন মাথাব্যথার তীব্রতা এবং ঘনত্ব কমাতে পারে। যা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেয়।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
Cochrane Database of Systematic Reviews-এ প্রকাশিত একটি মেটা বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, আকুপাংচার মাইগ্রেনের তীব্রতা এবং ঘনত্ব কমাতে প্লাসিবোর চেয়ে বেশি কার্যকরী। প্রফিল্যাকটিক ওষুধের চিকিৎসার সাথে তুলনা করা যায়।
ছোট বড় সবাই কেন অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে

৩. আকুপাংচার দিয়ে ঘুমের উন্নতি
ঘুম হল ন্যাচারাল ঔষধ। যা আমাদের সার্বিক সুস্থতায় কাজে লাগে। অনেকেই অনিদ্রায় ভোগেন। নানা রকম সমস্যা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। আকুপাংচার ঘুমের গুণমান উন্নত করে। রাতভর ভালো ঘুমের জন্য এটা কার্যকর চিকিৎসা হতে পারে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
আকুপাংচার সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদনকে বাড়ায়। শরীর কে শিথিল করে। শরীরের সার্কেডিয়ান ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুম নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলিতে কাজ করে। অনিদ্রা, স্লিপ অ্যাপনিয়া, এবং অস্থির লেগ সিন্ড্রোমের যন্ত্রণা উপশমে আকুপাংচার সাহায্য করতে পারে।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
জার্নাল অফ স্লিপ রিসার্চ-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা করে। সেখানে দেখা গেছে, আকুপাংচার চিকিৎসা গ্রহণকারী বিছানায় গেলে আগের চেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘুমিয়ে পরেন। ঘুম গভীর হয় এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে হয়।
দুশ্চিন্তা বন্ধের কৌশল গুলো জেনে নিন

৪. স্ট্রেস কমাতে আকুপাংচার
সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে। জীবন যাপনে যুক্ত হচ্ছে হরেক রকম গ্যাজেট। নানান রকম ডিভাইস। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় হচ্ছে মুল্যবান সময়। বাড়ছে স্ট্রেস। স্ট্রেস সব রোগের বন্ধু হিসেবে কাজ করে। আকুপাংচার স্ট্রেস কমায়।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
আকুপাংচার হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (এইচপিএ) গ্রন্থিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে। এন্ডোরফিনের উৎপাদন বাড়ায়, ফলে স্ট্রেস কমে। এটি স্ট্রেসের সাথে যুক্ত হরমোন কর্টিসলের মাত্রাও কমায়। যার ফলে প্রশান্তি এবং সুস্থতা অনুভুত হয়।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
জার্নাল অফ এন্ডোক্রিনোলজিতে প্রকাশিত একটি র্যান্ডমাইজড নিয়ন্ত্রিত ট্রায়াল প্রকাশ করা হয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে যে আকুপাংচার উল্লেখযোগ্যভাবে কর্টিসলের মাত্রা কমিয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ক্রমাগত স্ট্রেস থেকে রেহাই দিয়েছে। গবেষণায় উপসংহারে বলা হয়েছে যে, আকুপাংচার দীর্ঘস্থায়ী চাপ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অবস্থার জন্য একটি কার্যকর চিকিৎসা হতে পারে।
চর্বি ঝরিয়ে দ্রুত ওজন কমানোর উপায়

৫. আকুপাংচার চিকিৎসা উদ্বেগ, বিষণ্ণতায়
উদ্বেগ আর বিষণ্ণতা মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। জীবনযাপন অস্থির করে তোলে। উদ্বেগ, বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে আকুপাংচার থেরাপি ভালো কাজ করে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
আকুপাংচার উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। মস্তিস্কের একটা অংশ আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রন করে। এটি সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং এন্ডোরফিনের নিঃসরণ ঘটায়। যা মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
সাইকিয়াট্রিক রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যে আকুপাংচার উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার লক্ষণগুলি কমাতে জ্ঞানীয়-আচরণগত থেরাপির (সিবিটি) মতোই কার্যকর। আকুপাংচার গ্রহণকারী অংশগ্রহণকারীরা মেজাজে উল্লেখযোগ্য উন্নতি, উদ্বেগের মাত্রা হ্রাস এবং সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা জানিয়েছেন।

৬. দীর্ঘদিনের ব্যাথায় আকুপাংচার চিকিৎসা
ব্যাথা কারও কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাত, পিঠে ব্যাথা, কোমরে ব্যাথা ইত্যাদি। মানুষ দুর্বল হয়ে পরে। সারা বিশ্বেই এমনটা দেখা যায়। আকুপাংচার চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। ব্যাথার চিকিৎসায় সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
আকুপাংচারের বেদনানাশক প্রভাবগুলি অন্তঃসত্ত্বা ওপিওডের মুক্তি এবং ব্যথা সংকেত পথের মড্যুলেশনের মাধ্যমে অর্জন করা হয়। আকুপাংচার এছাড়াও প্রদাহ কমায় এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, ব্যথা উপশম এবং টিস্যু নিরাময়ে অবদান রাখে।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
২০১২ সালে Archives of Internal Medicine এক Individual Patient Data Meta-analysis প্রকাশ করে। তারা ১৮০০০ রোগীর পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে যে, আকুপাংচার – শ্যাম (sham) আকুপাংচার ও প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় দীর্ঘদিনের ব্যথা কমাতে statistically significant benefit দেয়।
American College of Physicians (ACP) 2017 guideline ক্রনিক লো-ব্যাক পেইনের ক্ষেত্রে non-drug থেরাপি হিসেবে আকুপাংচারকে একটি প্রাথমিক বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছে।

৭. স্লিপার বেনিফিট আকুপাংচার চিকিৎসা
আকুপাংচার স্যান্ডেল পাওয়া যায়। যা এমবেডেড আকুপ্রেশার পয়েন্টগুলির সাথে ডিজাইন করা। এই স্যান্ডেল গুলি পায়ের মূল আকুপাংচার পয়েন্টগুলিকে উদ্দীপিত করে। সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য কাজ করে।
প্রক্রিয়া এবং সুবিধা
বিশেষ স্যান্ডেল গুলো পায়ের তলায় নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করে। যে কারনে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হলে ব্যাথা কমে যায়। সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখে।
ক্লিনিক্যাল প্রমাণ
জার্নাল অফ অল্টারনেটিভ অ্যান্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে আকুপাংচার স্যান্ডেল নিয়মিত ব্যবহারের ফলে ব্যথা উপশম, স্ট্রেস হ্রাস এবং সামগ্রিক শারীরিক সুস্থতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা তাদের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তাদের জীবনযাপনে অস্বস্তি কমে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন।
আকুপাংচার চিকিৎসা নিয়ে ইউনেস্কোর রিপোর্ট

এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আকুপাংচার চিকিৎসা করানো যায়। আপনি চাইলে চিকিৎসা নিয়ে পারেন।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – ২০/০৮/২০২৫ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া।