সন্তানের সাথে ১০ টি ভুল করছেন: বাবর থেকে আজকের অভিভাবকত্বের শিক্ষা
আমাদের সন্তানেরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় অংশ। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্ন থাকি। অনেক সময় তাদের আচরণ বা কাজ আমাদের কাছে ভুল, এমনকি বিপজ্জনক মনে হয়। ফলস্বরূপ, আমরা তাদের বকাঝকা করি, শাসন করি, বা কখনও কখনও কঠোর ব্যবহার করি।
তবে আমরা ভুলে যাই, আমাদের বেড়ে ওঠার সময় ও পরিবেশ এবং তাদের বেড়ে ওঠার সময় ও পরিবেশ এক নয়। সময়ের এই ব্যবধানের কারণেই অনেক সময় সন্তানের আচরণ আমাদের রাগান্বিত করে তোলে এবং আমরা মেজাজ হারাই।
সন্তানকে সঠিক পথে রাখার জন্য শাসনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলো—বোঝা, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ। বিশ্ব ইতিহাসের এক মহান পিতার কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক, যিনি সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
সহিংস মুভি দেখে যা অর্জন করছেন , তা কিভাবে প্রভাব ফেলছে আপনার জীবনে !!

সন্তানের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ: সম্রাট বাবর ও হুমায়ুন
এটি এক কিংবদন্তী পিতার গল্প—মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর।
একবার সম্রাটের বড় ছেলে শাহজাদা হুমায়ুন মীর্জা দীর্ঘ চার মাস পিতার সাথে দেখা করেননি এবং সম্রাটের দুটি চিঠির কোনো উত্তরও দেননি। হুমায়ুনের এমন আচরণে বাবর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন।
একদিন রাজকার্যের সময় খবর এল যে হুমায়ুন এসেছেন। সম্রাট তাঁকে তখনই রাজসভায় উপস্থিত হতে বললেন। কিন্তু খবর বাহক ভীত কণ্ঠে জানালেন, “শাহজাদা অপারগ। তিনি অচেতন অবস্থায় আছেন এবং তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে।”
সম্রাট বাবর তৎক্ষণাৎ রাজসভা ভেঙে ছুটে গেলেন পুত্রের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখলেন, হুমায়ুন প্রায় মৃত মানুষের মতো পড়ে আছেন। ব্যক্তিগত চিকিৎসক জানালেন, সব চিকিৎসা দেওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু শাহজাদাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশা নেই—এখন শুধু আল্লাহর করুণা প্রয়োজন।
দিল্লির শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের সভা বসল। তারাও একই কথা বললেন। শেষ পর্যন্ত সুফি সাধক মীর আবুল কাশিমকে ডাকা হলো। তিনি সম্রাটকে বললেন, “পুত্রের প্রাণ রক্ষার বিনিময়ে যদি আপনি আপনার অতি প্রিয় কোনো বস্তু দান করেন, তবে হয়তো শাহজাদার জীবন রক্ষা পেতে পারে।”
বাবর স্থির কণ্ঠে বললেন, “আমার কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। আমি আমার পুত্রের জন্য আমার প্রাণ দিতে প্রস্তুত।”
হতভম্ব সাধক বললেন, “আলম্পানাহ, আপনি একাজ করতে পারেন না! আপনি বরং পৃথিবীর মূল্যবান সম্পদ, কোহিনূর হীরা দান করে দিন।”
বাবর জবাব দিলেন, “আমার পুত্রের জীবনের দাম কি সামান্য একখণ্ড হীরা?”
অচেতন হুমায়ুন মীর্জা বিছানায় শুয়ে আছেন। সম্রাট বাবর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভেতরে শুধু তিনটি মোমবাতি জ্বলছে, আর বাবর একা। তিনি পুত্রের মাথার পাশ থেকে ঘুরতে শুরু করলেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন, “পরম করুণাময়, আমার পুত্রের ব্যাধি তুমি আমার শরীরে ধারন করো। তুমি আমার পুত্রকে সুস্থ করে দাও।”
সম্রাট তিনবার এভাবে চক্কর দেওয়ার পরই অচেতন হুমায়ুন চোখ মেলে তাকালেন এবং ডাকলেন, “বাবা, আপনি এখানে কী করছেন?”
পুত্রের সেই কালান্তক ব্যাধি নিজের শরীরে ধারণ করে সেই মহান পিতা, বাবর, মাত্র ৫০ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। এই ঘটনা সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালোবাসার চূড়ান্ত নিদর্শন।
জেনে নিন ন্যাচারালি একমাসে ১০ কেজি ওজন কমানোর উপায়।

সন্তানের সাথে করা ১০টি সাধারণ ভুল
সম্রাট বাবরের মতো আত্মত্যাগ হয়তো সম্ভব নয়, তবে সন্তানের জীবনে সুখ ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আপনার দৈনন্দিন আচরণে যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। এখানে এমন ১০টি ভুল তুলে ধরা হলো, যা অনেক অভিভাবক অজান্তেই করে থাকেন:
১. অতিরিক্ত বকাঝকা ও ভয় দেখানো
সারাক্ষণ ‘এটা ধরোনা, ওটা করোনা’ বলে সন্তানকে সন্ত্রস্ত রাখা বা ছোটখাটো কারণে মারধর করা ঠিক নয়। শাসন তখনই করুন, যখন কোনো নির্দিষ্ট অপকর্ম বা অন্যায় হয়। সবসময় নেতিবাচক কথা বললে সন্তান লেখাপড়ার আগ্রহ বা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে, যা বাবা-মায়ের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ককে খারাপ করে।
২. বিশেষ দিনগুলোতে অনুপস্থিত থাকা
সন্তানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন—যেমন পরীক্ষার রেজাল্টের দিন, স্পোর্টসের দিন বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে—যত কাজই থাকুক, সময় করে তার পাশে থাকুন। আপনার উপস্থিতি তার আনন্দের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে এবং তাকে হীনমন্যতা থেকে রক্ষা করবে।
সন্তানের খুনির প্রতি মায়ের আচরন, অবাক দুনিয়া !!

৩. দৈহিক উপস্থিতি, আত্মিক অনুপস্থিতি
আপনি ঘরে আছেন, কিন্তু মোবাইল বা অন্য কাজে ব্যস্ত। এটি দৈহিক উপস্থিতি, কিন্তু আত্মিক অনুপস্থিতি। সন্তানের পাশে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও থাকুন। তার খেলাধুলায় যোগ দিন। আজ আপনি তার জন্য যে সময় ব্যয় করছেন, ২০ বছর পর আপনার সন্তানও আপনার জন্য সময় ব্যয় করবে।
৪. ডিভাইসকে ‘আয়া’ বানানো
নিজেরা একটু আরাম করার জন্য বাচ্চাদের হাতে মোবাইল বা অন্য ডিভাইস তুলে দেওয়া একটি বড় ভুল। কার্টুন দেখিয়ে খাবার খাওয়ানো বা ডিভাইস আসক্তি বাড়িয়ে দেওয়া শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক দক্ষতা বিকাশে বাধা দেয়। সৃজনশীল খেলনা দিন এবং বাস্তবে অন্য শিশুদের সাথে খেলার সুযোগ করে দিন।
৫. ছোট বলে কথা অগ্রাহ্য করা
বাচ্চারা কিছু বলতে এলে “তুমি ছোট, এসব বুঝবে না” বলে তাদের কথা উড়িয়ে দেবেন না। এমন কথা বারবার বললে তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে পারে। তারা কিছু বললে, মনোযোগ দিন এবং গুরুত্ব অনুযায়ী ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন।
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব নিয়ে কথা বলছেন শায়খ আহমাদ উল্লাহ

৬. আর্থিক ধারণা দিতে দেরি করা
কিশোর বয়সে সন্তানকে হাতখরচ দিন। বাজারে গেলে তাকে সাথে নিয়ে যান। তাকে শেখান কীভাবে কাঁচাবাজার করতে হয়, কীভাবে টাকা ম্যানেজ করতে হয়। টাকা পয়সার সঠিক ব্যবস্থাপনা জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই ছোটবেলা থেকেই আয়-ব্যয়ের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিন।
৭. আনন্দময় শৈশবের সুযোগ সীমিত করা
শহর জীবনে খেলাধুলা ও আনন্দের সুযোগ সীমিত। এই সীমিত সুযোগের মাঝেই সময় পেলেই বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটতে বের হোন। রাস্তা, পার্ক, জাদুঘর বা সি-বিচে নিয়ে যান। নতুন মানুষ ও পরিবেশের সাথে পরিচয় তার ভাবনার পরিধি বাড়াতে সাহায্য করবে।
৮. যথেষ্ট আদর ও স্পর্শের অভাব
সুযোগ পেলেই বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরুন। বিজ্ঞানীরা বলেন, বাবা-মা বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরলে তাদের স্ট্রেস কমে যায় এবং তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জন্ম নেয়। নিয়মিত এই মমতা প্রকাশ পরস্পরের মধ্যে বন্ধনকে দৃঢ় করে। আপনার সন্তানের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করুন।

৯. বিভ্রান্তিমূলক বা অসংগতিপূর্ণ কথা বলা
যদি বলেন যে রাত ৮টার পর মোবাইল বা টিভি দেখা যাবে না, তবে কোনো কারণে ব্যস্ত থাকলে নিজেই বাচ্চাকে মোবাইল দিয়ে বসিয়ে দেবেন না। এমন অসংগতিপূর্ণ আচরণে বাচ্চারা কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা বুঝতে পারে না। নিয়মের ক্ষেত্রে সবসময় স্পষ্ট ও অবিচল থাকুন।
১০. বাইরের কাউকে দিয়ে শাসন করানো
আপনার সন্তানকে আপনিই সবচেয়ে ভালো চেনেন। ব্যক্তিগত কারণে বা ভুল বোঝাবুঝির জেরে বাইরের কাউকে দিয়ে সন্তানকে শাসন করাবেন না। এতে আপনার প্রতি সন্তানের আস্থা কমে যেতে পারে। সন্তানের ভবিষ্যৎ, তার খাওয়া-চলাফেরা, পড়াশোনা—সবকিছু নিজেই নির্ধারণ করুন। বাইরের মানুষের পরামর্শ নিন, তবে যৌক্তিকতা বিচার করে আপনার সিদ্ধান্ত নিজেই নিন।
আপনার দাদা দাদীদের বিয়ে কিভাবে নির্ধারিত হত, আমাদের সেই গ্রামীণ কাহিনী।

যাদের কম বয়সী সন্তান আছে তাদের কে পোস্টটি শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – তাং – ২০/০৪/২০২৪ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী









