শীতে ঠান্ডা পানিতে গোসল: বিজ্ঞান কী বলে?
ঠান্ডা পানিতে গোসল বা কোল্ড শাওয়ার (Cold Shower) দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, বিভিন্ন দেশে। সুস্থতা এবং উদ্দীপনা পেতে। আধুনিক বিজ্ঞানও এর কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা খুঁজে পেয়েছে।
শীতে ঠান্ডা পানিতে গোসলের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
শরীরের তাপমাত্রা যখন হঠাৎ করে ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে আসে, তখন এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১. মানসিক উদ্দীপনা ও মনোযোগ বৃদ্ধি (Mental Alertness)
ঠান্ডা পানি যখন চামড়ার স্নায়ু প্রান্তগুলোকে দ্রুত আঘাত করে, তখন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে (Central Nervous System) একটি বৈদ্যুতিক সংকেত পৌঁছে যায়।
- বিটা-এন্ডোরফিন নিঃসরণ: এতে করে মস্তিষ্কে নোরপাইনফ্রিন (Norepinephrine) নামক নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। নোরপাইনফ্রিন (যা অ্যাড্রেনালিনের সাথে সম্পর্কিত) মেজাজ, মনোযোগ এবং সতর্কতার মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
- মেজাজ উন্নতকরণ: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার লক্ষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। কারণ মস্তিষ্ক তাৎক্ষণিকভাবে বিটা-এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসৃত করে। যা প্রাকৃতিক ব্যাথানাশক হিসেবে কাজ করে।
দ্রুত চর্বি ঝরাতে মাত্র ১ টি পয়েন্ট
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে (Immune System)
ঠান্ডা পানির নিয়মিত ব্যবহার শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়াতে পারে।
- লিম্ফোসাইট বৃদ্ধি: নিয়মিত ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে এলে শরীরে শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Cells) বিশেষ করে লিম্ফোসাইট (Lymphocytes)-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই কোষগুলো শরীরকে রোগ ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়।
৩. রক্ত সঞ্চালন উন্নত করা (Improved Circulation)
ঠান্ডা পানি যখন শরীরের ওপর পড়ে, তখন শরীর তাপমাত্রা ধরে রাখার জন্য দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
- ভাসোকনস্ট্রিকশন ও ভাসোডাইলেশন: প্রথমে ত্বক সংকুচিত হয় (ভাসোকনস্ট্রিকশন), রক্তকে দেহের কেন্দ্রে (Vital Organs) পাঠিয়ে দেয়। গোসল শেষে যখন তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়। তখন রক্তনালীগুলো প্রসারিত হয় (ভাসোডাইলেশন)। এই দ্রুত সংকোচন ও প্রসারণ প্রক্রিয়া রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তাজা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ বাড়ায়।
৪. পেশির ক্ষতি দ্রুত মেরামত (Muscle Recovery)
ব্যায়ামের পর পেশি তীব্র ব্যাথা (Delayed Onset Muscle Soreness বা DOMS) ? ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করুন। সারা পৃথিবীতে ক্রীড়াবিদরা এমন টা করেন। তারা অনেক বরফ ঠাণ্ডা পানিতে ডুব দেন।
- প্রদাহ হ্রাস: ঠান্ডা পানি পেশির প্রদাহ (Inflammation) এবং ফোলা কমাতে সাহায্য করে। এটি ক্ষতিকারক মেটাবলিক বর্জ্য পদার্থ দ্রুত শরীর থেকে বের করে পেশিকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।
মদ খেয়ে কোন বিপদে পরল মোনামি ম্যাম আর তার স্বামী

৫. মেটাবলিজম ও ফ্যাট বার্নিং
ঠান্ডা তাপমাত্রা শরীরে বাদামী ফ্যাট (Brown Fat) সক্রিয় করতে উৎসাহিত করে।
- বাদামী ফ্যাট সক্রিয়করণ: বাদামী ফ্যাট হলো এক ধরনের বিশেষ চর্বি যা শরীরকে গরম রাখার জন্য ক্যালোরি পোড়ায় (burns calories)। নিয়মিত ঠান্ডা পানির এক্সপোজার মেটাবলিজম বা বিপাক হার বাড়াতে এবং শরীরের চর্বি পোড়াতে সাহায্য করতে পারে।
উইম হফ: দ্য আইসম্যান (Wim Hof: The Iceman)
উইম হফ একজন ডাচ মোটিভেশনাল স্পিকার এবং চরম অ্যাডভেঞ্চারার। যিনি বরফের পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকার এবং মেরু অঞ্চলে খালি পায়ে দৌড়ানোর মতো অবিশ্বাস্য কাজের জন্য পরিচিত। তাঁর দর্শনটি মূলত একটি পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে, যা উইম হফ মেথড (Wim Hof Method) নামে পরিচিত।
উইম হফ মেথডের তিনটি স্তম্ভ
উইম হফ মেথড তিনটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে:
১. কোল্ড থেরাপি (Cold Therapy): নিয়মিত ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে আসা। যেমন ঠান্ডা পানিতে গোসল করা বা আইস বাথ নেওয়া। এর উদ্দেশ্য হলো শরীরের মানসিক ও শারীরিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করা।
২. শ্বাস-প্রশ্বাস (Breathing): এক ধরনের নির্দিষ্ট ছন্দময় শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল। এর মধ্যে গভীর ও দ্রুত শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাস ধরে রাখা অন্তর্ভুক্ত। এই অনুশীলন শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে শরীরের pH লেভেলকে ক্ষারীয় (Alkaline) করে তোলে।
৩. প্রতিশ্রুতি/মনোযোগ (Commitment/Mindset): এই পদ্ধতির মাধ্যমে সৃষ্ট চাপ সহ্য করার জন্য মনকে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত করা এবং মনের শক্তিকে কাজে লাগানো।
কোল্ড শাওয়ারের বেনিফিট নিয়ে কথা বলছেন ডাঃ এরিক বারগ

উইম হফ কেন বরফের পানিতে গোসল করেন?
উইম হফ বিশ্বাস করেন যে এই সম্মিলিত পদ্ধতি মানুষকে তাদের স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্র (Autonomic Nervous System) এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune System) সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। যা সাধারণত মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞান তাঁর পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরে প্রদাহ কমানো এবং মানসিক চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
ঠান্ডা পানিতে গোসল শুরু করার সময় ধীরে ধীরে শুরু করা উচিত। বিশেষ করে যদি আপনার কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা (যেমন হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ) থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শুরু করার জন্য উষ্ণ পানিতে গোসল শেষে শেষ ৩০ সেকেন্ড ঠান্ডা পানি ব্যবহার করতে পারেন এবং ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে পারেন।
সেলিম হোসেন – তাং ০৯/১২/২০২৫ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া।
Reference: Dr Eric Berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.


