মানুষ কেন আত্মহত্যা করে: কারণ – লক্ষণ ও সমাধানের পথ
ভূমিকা: যখন জীবন অসহনীয় মনে হয়
মানুষ যখন গভীর কষ্ট, হতাশা বা সমস্যায় জর্জরিত হয়, তখন কখনো কখনো বাঁচার সব পথ রুদ্ধ মনে হতে পারে। এই চরম মুহূর্তে কেউ কেউ নিজের জীবন নিজ হাতে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়—সচেতনভাবে, নিজ উদ্যোগে, নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীকে বিদায় জানানোকেই আত্মহত্যা বলে।
এইভাবে একটি জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি খুবই দুঃখজনক। আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য, আমাদের নিজেদের এবং প্রিয়জনদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য এই ঘটনার পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো জানা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সামান্য সহানুভূতি, একটি পরামর্শের হাত, বা সময়মতো সঠিক সমর্থন হয়তো কারও জীবন রক্ষা করতে পারে।
জ্ঞ্যানি ব্যাক্তি দিলেন সুখের সংজ্ঞা

আত্মহত্যার মূল ১০টি কারণ
আত্মহত্যার প্রবণতা একটি জটিল বিষয়, যা সাধারণত বহুবিধ মানসিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং জৈবিক কারণে ঘটে থাকে। এখানে প্রধান ১০টি কারণ তুলে ধরা হলো:
১. গভীর হতাশা (Depression): এটি আত্মহত্যার প্রধান কারণ। দীর্ঘমেয়াদি অবসাদ, বিষণ্ণতা এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিকে একসময় শয়তানের প্ররোচনায় নিজেকে নিঃসঙ্গ ও মূল্যহীন ভাবতে বাধ্য করে।
২. মানসিক রোগ: স্কিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, উদ্বেগজনিত সমস্যা (Anxiety Disorder) বা অন্যান্য মানসিক রোগ যখন ক্রমাগত যন্ত্রণা দিতে থাকে, তখন অনেকেই একে মুক্তি মনে করে।
৩. সম্পর্কগত সমস্যা: দাম্পত্য কলহ, ভালোবাসার মানুষের থেকে বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা (যেমন সিফাতের ঘটনা) বা পারিবারিক অসহনীয় অশান্তি আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক সমস্যা: চাকরি হারানো, ব্যবসায় বিপুল লোকসান বা দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা অনেক সময় মানুষকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
৫. সামাজিক চাপ ও অপমান: কোনো ঘটনায় সমাজে দারুন লজ্জিত হওয়া, মান-সম্মান হারানোর ভয় বা কর্মস্থলে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হওয়ার চাপ অনেকে সহ্য করতে পারে না।
মরুভুমিতেও সুখ আছে, জীবনে যেভাবে সুখী হবেন।

৬. মাদকাসক্তি ও নেশা: মাদক বা অ্যালকোহলে আসক্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই তীব্র বিষণ্ণতায় ভোগে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায় এবং তারা হঠকারিতায় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৭. দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ব্যথা: ক্যান্সার, পক্ষাঘাত বা এমন কোনো কষ্টদায়ক ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যার নিরাময় অনিশ্চিত, তখন অনেকে মৃত্যুকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি বলে মনে করে।
৮. পূর্বের আত্মহত্যার চেষ্টা বা ভাবনা: যাদের অতীতে আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা ছিল, তারা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
৯. মানিয়ে নিতে না পারা: নতুন পরিবেশে (যেমন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থল পরিবর্তন) বা জীবনের বড় ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা থেকেও হতাশা জন্ম নিতে পারে।
১০. সমর্থনের অভাব: পরিবার, বন্ধু বা সমাজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি, বোঝাপড়া বা সহযোগিতা না পেলে মানুষ নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করে এবং নিঃসঙ্গতা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।
অদ্ভুত ভাবে মারা গেলেন কবি জীবনানন্দ দাস।

মিথোজীবী অভিভাবকত্বের মনস্তত্ত্ব
র্যাব কর্মকর্তা পলাশ সাহার চলে যাওয়ার ঘটনাটি পরিবারিক মনস্তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে আসা ডাক্তার মহিলার ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে— মিথোজীবী অভিভাবক (Symbiotic Parent)।
একজন মিথোজীবী অভিভাবক (মা বা বাবা) ক্রমাগত সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করেন। তারা সন্তানকে আবেগীয় ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রে এতটাই নির্ভরশীল করে তোলেন যে, সন্তান অভিভাবককে ছাড়া থাকার আতঙ্ক নিয়ে বাঁচে।
- ফলাফল: এই ধরনের সন্তানরা জীবনের ছোটখাটো হতাশা বা পরাজয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। প্রিয় মানুষেরা (স্বামী, প্রেমিকা বা বন্ধু) যখন মায়ের প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন নিঃসঙ্গতা তাদের গ্রাস করে। এই ধরনের পারিবারিক জটিলতাও আত্মহত্যার পেছনে বড় মনস্তাত্ত্বিক কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে।
স্ত্রীর হাতে কেন এভাবে মরছে স্বামীরা।

বাস্তব উদাহরণে আত্মহত্যার চিত্র
আত্মহত্যার ঘটনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে আছে:
| ঘটনা | ভুক্তভোগী | সম্ভাব্য কারণ |
|---|---|---|
| র্যাব কর্মকর্তার মৃত্যু | পলাশ সাহা (র্যাব কর্মকর্তা) | দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক জটিলতা (সম্ভবত মিথোজীবী অভিভাবকত্বের প্রভাব)। |
| চিকিৎসকের মৃত্যু | ডাঃ অপর্ণা বসাক (চিকিৎসক) | প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া, বিরহ, অপমান এবং প্ররোচনা। |
| অভিনেত্রীর মৃত্যু | তমা খান (অভিনেত্রী) | দীর্ঘ দাম্পত্য কলহ এবং স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তি। |
| কিশোরদের প্রবণতা | ১৩-১৯ বছর বয়সীরা | রিলেশনশিপজনিত সমস্যা (যেমন সিফাতের প্রেমিকার কবরের পাশে দাফনের অনুরোধ), পড়াশোনার চাপ ও মানসিক চাপ মানিয়ে নিতে না পারা। |
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ—বিশেষ করে ১৩-১৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করছে, যা মোট সংখ্যার প্রায় ৬৫.৭ শতাংশ। এটি একটি চরম উদ্বেগের বিষয়।
বসের আচরন কুকুরের মত, কুকুরের আচরন নিয়ে গল্প।

ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা
ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যাকে একটি বড় কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মানুষের জীবন আল্লাহর দেওয়া আমানত, যা নিজের ইচ্ছায় শেষ করার কোনো অধিকার নেই।
- জাহান্নামে স্থায়ী শাস্তির হাদিস: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো জিনিস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে জিনিস দিয়েই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।” (সহীহ বুখারি, হাদিস: ৫৭৭৮)
- উদাহরণস্বরূপ, কেউ বিষ পান করলে কিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামে বারবার বিষ পান করানো হবে।
- আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া নিষিদ্ধ: ইসলামে হতাশাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরা যুমার: ৫৩)
আত্মহত্যাকারীর জানাজা
আত্মহত্যাকারী কবিরা গুনাহে লিপ্ত হলেও সে কাফের নয়, তাই তার জানাজা পড়তে হবে। তবে সমাজের অনুসরণীয় বড় আলেম ও নেতৃস্থানীয়দের উচিত এমন জানাজায় অংশগ্রহণ না করা, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে আত্মহত্যা একটি গর্হিত ও মহাপাপ। (আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসাঈ: ২১০২)
আত্মহত্যা নিয়ে রিসার্চ পড়ুন The new England journal of medicine

ব্লগ পোস্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – তাং ২০/০৫/২০২৫ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.









