ফার্টিলিটি কম ও সন্তান না হওয়ার কারণ: জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং খাদ্য পরিকল্পনা
বড় হলরুম, সারি সারি চেয়ার—জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকা দম্পতিদের চোখেমুখে বিষণ্ণতা। কারও বিবাহিত জীবনের বয়স ৭, ১০ বা ১৫ বছর, কিন্তু সংসারে ‘বাবু’ আসছে না। চিকিৎসকের চেম্বারে চলছে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, যেখানে কারও শুক্রাণু কম, কারও বা ডিম্বাণু। বর্তমান সময়ে সন্তান ধারণে দেরি হওয়া বা একেবারেই সন্তান না হওয়া একটি সাধারণ অথচ গভীর উদ্বেগের কারণ।
এর মূল কারণগুলো কী? আমাদের স্ট্রেসে পরিপূর্ণ জীবন, বাজে লাইফস্টাইল, দূষিত পরিবেশ, ভেজাল খাবার এবং শারীরিক যত্নের অভাব। এই কারণগুলো সম্মিলিতভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ের ফার্টিলিটি (Fertility) বা উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে।
সন্তানের স্বাভাবিক জন্মদানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সুস্থতা দরকার। তাই গর্ভাবস্থায় ও গর্ভধারণের পূর্বে মা-বাবার সুস্থতার জন্য বিশেষ খাদ্য পরিকল্পনা এবং হেলদি লাইফস্টাইল আবশ্যক।
আসুন জেনে নিই এমন কিছু খাবার ও খাদ্য উপাদান সম্পর্কে যা উর্বরতা বৃদ্ধি করবে, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং দম্পতিদের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করবে।
কেন উর্বরতা কমে যায়?
বাবা-মা হতে না পারার কারণগুলো সাধারণত পরিবেশ, জীবনধারা এবং শারীরিক অবস্থার সম্মিলিত ফল:
- স্ট্রেস ও ঘুম: দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা সরাসরি ডিম্বস্ফোটন এবং শুক্রাণু উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।
- অতিরিক্ত ওজন: শরীরের অতিরিক্ত ওজন ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মান কমিয়ে দিতে পারে এবং হরমোনাল প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
- দূষিত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য: ভেজাল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (Processed Foods) শরীরে প্রদাহ (Inflammation) তৈরি করে এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অভাব ঘটায়।
- পর্যাপ্ত যত্নের অভাব: ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং ব্যায়ামের অভাব প্রজনন স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলুন ন্যাচারালি

ফার্টিলিটি বাড়াতে সহায়ক ১০টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান
ফার্টিলিটি বৃদ্ধিতে সহায়ক কিছু খাবার এবং খাদ্য উপাদান নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ভিটামিন ডি (Vitamin D)
- কাজ: শরীরের যৌন হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে, যা ডিম্বস্ফোটন এবং হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে।
- উৎস: ডিম, চর্বিযুক্ত মাছ, দুগ্ধজাত খাবার এবং কড লিভার ওয়েল।
- করনীয়: প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে ৩০-৪৫ মিনিট গায়ে রোদ লাগাতে হবে।
২. ভিটামিন ই (Vitamin E)
- কাজ: পুরুষদের শুক্রাণুর স্বাস্থ্য এবং গতিশীলতা উন্নত করে। এটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর ডিএনএ-র অখণ্ডতা রক্ষা করে।
- উৎস: সূর্যমুখী বীজ, বাদাম, জলপাই, পালং শাক, পেঁপে এবং অন্যান্য সবুজ শাক।
৩. ভিটামিন সি (Vitamin C)
- কাজ: মহিলাদের উর্বরতা এবং হরমোনের মাত্রা উন্নত করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে— শুক্রাণুর গুণমান ও গতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং শুক্রাণুকে একত্রে জমে থাকার প্রবণতা প্রতিরোধ করে।
- উৎস: আমলকি, পেয়ারা, লাল মরিচ, ব্রকলি, ক্র্যানবেরি, বাঁধাকপি, আলু, টমেটো এবং সাইট্রাস ফল।
মেরিন কোলাজেন কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

৪. লাইপোইক এসিড (Lipoic Acid)
- কাজ: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। মহিলাদের প্রজনন অঙ্গ রক্ষা করে এবং পুরুষদের শুক্রাণুর গুণমান ও গতিশীলতাকে উন্নত করে।
- উৎস: আলু, পালং শাক এবং লাল মাংসের অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়।
৫. ভিটামিন বি৬ (Vitamin B6)
- কাজ: হরমোন এবং রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, যা প্রিমিনুস্ট্রয়াল সিনড্রোম (PMS) কমাতে সহায়ক।
- উৎস: টুনা মাছ, কলা, টার্কি, লিভার, স্যামন, পালং শাক, বেল মরিচ, রসুন, ফুলকপি এবং বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি।
৬. ভিটামিন বি১২ (Vitamin B12)
- কাজ: শুক্রাণুর গুণমান ও উৎপাদন বাড়ায়। ডিম নিষিক্তকরণে এন্ডোমেট্রিয়ামের আস্তরণকে বাড়িয়ে তুলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা হ্রাস করে।
- উৎস: ঝিনুক, লিভার, ক্যাভিয়ার (মাছের ডিম), মাছ, কাঁকড়া, গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার।
লিভার ও গাট ডিটক্স করার সহজ উপায়

৭. ফলিক এসিড (Folic Acid)
- কাজ: গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন। এটি ভ্রূণের বিকাশে নিউরাল টিউব ত্রুটি, জন্মগত হার্টের ত্রুটি এবং অন্যান্য জন্মগত জটিলতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- উৎস: পুঁইশাক, পাটশাক, মুলাশাক, পেঁপে, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, বাঁধাকপি, বিভিন্ন ধরনের ডাল (মসুর, মুগ) এবং সরিষা, তিল, তিসি ও সূর্যমুখীর বীজে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।
৮. সেলেনিয়াম (Selenium)
- কাজ: একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুকে ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। এটি স্বাস্থ্যকর শুক্রাণু তৈরির জন্যও প্রয়োজনীয়।
- উৎস: লিভার, কড, হালিবুট, টুনা, সালমন, চিংড়ি, ক্রিমিনি মাশরুম এবং ব্রাজিল নাট।
মানুষের নাম কেন ভুলে যাচ্ছেন, কারন এবং সমাধান জেনে নিন

৯. জিঙ্ক (Zinc)
- কাজ (মহিলা): প্রজনন সিস্টেমের সর্বোত্তম কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- কাজ (পুরুষ): পুরুষের উর্বরতা বজায় রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিনারেলসগুলির মধ্যে অন্যতম।
- উৎস: গরুর কলিজা, ঝিনুক, গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, তিলের বীজ, কুমড়োর বীজ, দই এবং চিংড়ি। (রান্নার ফলে জিঙ্কের অপচয় হতে পারে, তাই কিছু খাবার কাঁচাও খাওয়া যায়)।
১০. অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (Essential Fatty Acids)
- কাজ (ওমেগা-৩): শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, সার্ভিকাল শ্লেষ্মা বাড়ায়, ডিম্বস্ফোটন উন্নত করে এবং প্রজনন অঙ্গে রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে জরায়ুর গুণমান উন্নত করে।
- উৎস: ফ্ল্যাক্স সিড, চিয়া সিডস, আখরোট, স্যামন মাছ এবং সার্ডিনস।
বিটরুটের অবাক করা উপকারিতা জেনে নিন

জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
উপরে উল্লেখিত খাদ্য উপাদান ছাড়াও আপনার ফার্টিলিটি ডায়েট-এ পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্যাট, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে:
- প্রসেসড ফুড (Processed Food)
- কোমল পানীয় এবং দোকানের জুস
- কেক, মিষ্টি ও জাঙ্ক ফুড (যেমন বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই)
যা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে:
- স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: ঘি, মাখন, নারিকেল তেল, অলিভ ওয়েল (এগুলো হরমোন উৎপাদনে সহায়ক)।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন।
- ব্যায়াম: নিয়মিত হালকা বা মাঝারি ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করুন।
- স্ট্রেস কমানো: যোগা, মেডিটেশন বা পছন্দের কাজ করে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন।
গাট এবং লিভার ডিটক্স নিয়ে বলছেন ডাঃ জেন গানটার

বাবা-মা হতে বহু টাকা খরচ না করে, আগে নিজের শরীরকে প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তানের জন্য প্রস্তুত করুন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শক্তিশালী হজমতন্ত্র এবং একটি সুস্থ জীবনধারা আপনার উর্বরতা বৃদ্ধি করে দ্রুত সন্তানের বাবা-মা হওয়ার পথে সাহায্য করবে।
যারা সন্তানের বাবা-মা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
লেখক: সেলিম হোসেন তারিখ: ১৩/০৯/২০২৫ ইং
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.









