ভয়াবহ মোবাইল রোগ: নোমোফোবিয়া (Nomophobia) বা মোবাইল ছাড়া থাকার ভয়
ঘুম ভাঙতেই হাত চলে যায় স্মার্টফোনে। মাঝরাতে হোক বা সকালে, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক—স্ক্রলিং চলতেই থাকে। এরপর হয়তো পাবজি বা ফ্রি ফায়ার। কেটে গেল দেড়-দুই ঘণ্টা।
আপনার সকালটা শুরু হলো এক অস্বাস্থ্যকর বিষয় দিয়ে। যা দেখলেন তার ভাবনা সারাক্ষণ মাথায় থাকবে, অপছন্দের মন্তব্য বা কন্টেন্ট মেজাজ গরম করে দেবে। কাজের ফোকাস নষ্ট হবে। অকারণে রিকশাওয়ালার সাথে বা বাস সুপারভাইজরের সাথে আপনার ঝগড়া লেগে যাবে।
সারাদিন ফোন যেন আপনার হাতেরই অংশ। পিনাকি ভট্টাচার্য কাকে গালি দিলেন, ইলিয়াস হোসেন কার গোপন কথা ফাঁস করলেন—এসব দেখতে স্ক্রলিং চলতেই থাকে। কাউকে মেসেজ দেওয়া, কল করা, ছবি এডিট করা বা মেইল করা—মোবাইল হাতে থাকবেই।
কারও সাথে কথা বলার সময়ও আপনার স্ক্রলিং চলে। আপনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না।
তরুণদের যৌন সক্ষমতা কেন কমে যাচ্ছে

মনোবিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কারও সাথে কথা বলার সময় তার চোখের দিকে তাকানো এবং হাসি মুখে কথা বলা জরুরি। এতে উক্ত ব্যক্তি সম্মানিত বোধ করেন। আপনি যদি ফোনের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন, তবে তিনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। এর ফলস্বরূপ ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্কে অবনতি হতে পারে, এমনকি আপনার ক্লায়েন্ট বা ব্যবসা কমে যেতে পারে।
তাহলে আপনার কী হয়েছে? আপনি কি অসুস্থ?
বিষয়টি জানতে হলে কিছু গবেষণা রিপোর্ট দেখা দরকার। প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে, কিন্তু এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, বিশেষ করে স্মার্টফোনের অত্যধিক ব্যবহার জীবনের জটিলতা বাড়িয়েছে।
গবেষণায় নোমোফোবিয়া
নোমোফোবিয়া (Nomophobia) বা নো মোবাইল ফোবিয়া হলো মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ভয়। এটা মাদকের আসক্তির মতোই ভয়াবহ। একজন মাদকাসক্ত যেমন নিজেকে অসুস্থ মনে করে না, তেমনি নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিও সহজে বুঝতে পারে না যে তার জীবনে কত বড় সমস্যা চলছে।
- ব্রিটেনের গবেষণা (২০১৯): এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে যে সব ব্রিটিশ মোবাইল ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে ৫৬ ভাগ মানুষ নোমোফোবিয়ায় ভুগছেন।
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ (২০২৩): সহযোগী অধ্যাপক তাজউদ্দিন শিকদার ও মার্ক ডি গ্রিফিটস-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই জরিপে (৫৮৫ জন শিক্ষার্থীর ওপর) দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে:
- মৃদু মাত্রায় আক্রান্ত: ৯.৪%
- মাঝারি মাত্রায় আক্রান্ত: ৫৬.১%
- গুরুতর মাত্রায় আক্রান্ত: ৩৪.৫%
খেয়াল করুন, আপনি কোন ভাগে পড়েন!
স্ত্রীকে বশে আনতে যে বইটি পড়তেই হবে

নোমোফোবিয়ার লক্ষণ (Nomophobia Symptoms)
মোবাইল আসক্তির এই লক্ষণগুলো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখুন:
১. ভয় ও নির্ভরশীলতা: প্রচণ্ড ভয় কাজ করে। ভয় থেকে মুক্তি পেতে মোবাইল ফোন বিছানায় নিয়ে ঘুমায়, এমনকি টয়লেটে গেলেও ফোন হাতে থাকে।
২. নোটিফিকেশন চেক: একটি নোটিফিকেশনও মিস যায় না। সব কিছু বারবার চেক করে।
৩. উদ্বেগ: ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে ব্যস্ত থাকে। ফোন ব্যবহার করতে না পারলে দুশ্চিন্তা হয়, বুক চেপে ধরে, দম আটকে আসে।
৪. অসহায়ত্ব: ফোন ছাড়া অসহায় অনুভব করে। বুক ধড়ফড় করে, শরীরে ঘাম হয়।
৫. সাথে রাখা: রোগী যে কোনো মূল্যে ফোন হাতে, পকেটে বা কাছে রাখবেই।
যেভাবে সহজেই দূর করবেন স্ট্রেস

নোমোফোবিয়ার কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে
নোমোফোবিয়া একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে:
- পড়াশোনা ও কাজে: পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বেড়ে যায়। নিজের কাজের প্রতি ফোকাস নষ্ট হয়।
- মানসিক স্বাস্থ্য: আত্মবিশ্বাস কমে যায়, বাড়ে অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা। ‘আমাকে দিয়ে কিছু হবে না’ এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়।
- খাবারের প্রতি অনিহা: মুখের স্বাদ কমে যায়, খাবারের প্রতি অনিহা দেখা দেয়। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মারাত্মক eating disorder দেখা যায়।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: অনলাইনে সময় কাটাতে গিয়ে একাকীত্ব বাড়ে, যা এখন সারা বিশ্বে মারাত্মক সমস্যা। আত্মীয়তা এবং বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।
- শারীরিক ভাবমূর্তি: কম বয়সীরা চেহারা ও শারীরিক গঠন নিয়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
কেন স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলছেন স্ত্রীরা

মদে আসক্ত দুই বন্ধুর গল্প
মদ মানুষকে জীবনের একঘেয়েমি থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি দেয়। মুহূর্তের জন্য বাস্তবতা ভুলে থাকা যায়। নোমোফোবিয়া আক্রান্ত রোগীও শান্তি পেতে চায়, কিন্তু মোবাইলে মূল্যবান সময়ের অপচয় করে জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
রাসেল আর ফারুকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং মদে দারুণভাবে আসক্ত ছিলেন। হাজার হাজার লিটার মদ খেয়ে শেষে দুজনে সিদ্ধান্ত নিলেন: আর মদ নয়। তারা এক বোতল ব্রান্ডি রেখে দিলেন এই শর্তে যে, খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে খাবেন।
একদিন কোনোমতে কাটার পর, পরদিন সন্ধ্যায় রাসেল ফারুকির অফিসে গিয়ে হাজির হলেন এবং বললেন, “বন্ধু, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, ব্রান্ডিটা একটু বের কর তো, দুই ঢোক মেরে দেই।” করুণ মুখে ফারুকি বললেন, “গতকালকেই আমি এমন অসুস্থ হয়ে পড়লাম! পুরো বোতল খেয়েও সুবিধা হয়নি। আজও শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।”
নোমোফোবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিও সেই ফারুকি বা রাসেলের মতোই তার আসক্তিকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করে। তবে চাইলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
যেভাবে শুন্য থেকে শিখরে উঠলেন মাহাথির মোহাম্মদ

নোমোফোবিয়া (Nomophobia) দূর করার কার্যকর উপায়
এই সমস্যার সমাধান মূলত আপনার নিজের হাতে। কোনো ঔষধ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না, সচেতনতাই একমাত্র পথ। ৭ দিনের একটি রুটিন দিয়ে শুরু করুন:
১. ফোন থেকে বিচ্ছিন্ন হোন (The Great Disconnect):
- রাত ৯টায় ফোনটা দূরে রেখে দিন।
- সকাল ৯টার পূর্বে ফোন ধরবেন না। এই সময়টা মানুষ সাধারণত অপ্রয়োজনীয় আলাপ করে।
- ফোন এয়ারপ্লেন (Airplane) মোডে রেখে দিন। প্রয়োজনে নিকটজনদের জন্য একটি ‘বাটন ফোন’ নাম্বার দিয়ে রাখুন।
২. নোটিফিকেশন বন্ধ:
- সব ধরনের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন। শুধু কল বা জরুরি মেসেজের জন্য অনুমতি দিন।
- বাজারে গেলে, হাঁটতে বের হলে বা বাসা থেকে অল্প সময়ের জন্য বের হলে ফোন সাথে নিবেন না।
৩. ফোকাস টাইম:
- দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় (কমপক্ষে ২ ঘণ্টা) মোবাইল, কম্পিউটার এবং টিভি থেকে দূরে থাকুন।
- সেই সময়টুকু পড়াশুনা করুন, হোম ওয়ার্ক শেষ করুন বা অফিসে জমে থাকা হাতের কাজ সেরে ফেলুন।
সুন্দরী জোহরার সেই কাহিনী জানেন কি

৪. অফলাইন সামাজিকতা:
- একই এলাকায় থাকলে বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের সাথে ফোনে নয়, সাক্ষাৎ করে কথা বলুন ও গল্প করুন। সামাজিক যোগাযোগ অনলাইনে নয়, অফলাইনে বাড়িয়ে দিন।
৫. শরীর চর্চা ও মনন:
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
- প্রতিদিন ৩০ মিনিট বই পড়ুন।
- জামাতে নামাজ আদায় করুন (নামাজের সময় বাসায় বা অফিসে ফোন রেখে যাবেন) অথবা মেডিটেশন করতে পারেন।
আপনার বিপদ ফারুকি এবং রাসেলের মতো মদের নেশা নয়—আপনি অনেকটাই সেইফ জোনে আছেন। ৭ দিনের রুটিন দিয়ে শুরু করুন এবং নিয়মগুলো পুরোদমে অনুসরণ করুন। অচিরেই পড়াশুনায় মনোযোগ আসবে, কাজে ফোকাস বাড়বে। জীবনে দারুন তৃপ্তি অনুভব করবেন।
Nomophobia নিয়ে ধ্রুব রাঠির ভিডিও দেখে ভয়ে কেঁপে উঠবেন

পোস্টটি সবার সাথে শেয়ার করুন। Nomophobia আক্রান্তদের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করুন।
লেখক: সেলিম হোসেন – তাং – ০৫/০৯/২০২৫ ইং তথ্যসূত্র: Dr Eric Berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.









