আইন পেশা কি: সুজানা ও দানিয়েলের কিংবদন্তি এবং একটি মহৎ যাত্রার ইতিহাস
চা-টেবিলের আড্ডা
“চা’টা খেতে দারুণ লাগছে,” বলল বেলাল আহমেদ।
“হুম, এতে বাটার আর মধু দেওয়া আছে। খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি ক্ষুধাও নিবারণ করে,” জাহিদ জবাব দিল। “তবে ইদানীং আমার খুব কৌতূহল— আইন পেশা কী। আজ এটা নিয়েই বলবি আমাকে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই বলব। আইন পেশার জন্ম ও ইতিহাস অত্যন্ত গভীর। কিন্তু তার আগে, তোকে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কথা মনে আছে? ব্রাজিলের খেলা হলে ক্যামেরা বার বার গ্যালারিতে ফোকাস করত এক তরুণীর দিকে— যার নাম ছিল সুজানা। তিনি ছিলেন মডেল ও ব্রাজিলিয়ান স্টার রোনালদোর প্রেমিকা।”
“হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। রোনালদোর খেলা এবং সুজানা— দু’জনেই সেসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল,” জাহিদ বলল। “কিন্তু আইন পেশার সাথে এই সুজানার কী সম্পর্ক?”
“আছে, সম্পর্ক আছে, তবে অন্য এক সুজানার সাথে— হাজার হাজার বছর আগের এক সুন্দরী সুজানার সাথে। তার সততা, রূপ এবং তাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাই আইন পেশার সূচনার অন্যতম ভিত্তি। তার কাহিনী আজও বাইবেলে স্থান পেয়েছে এবং আইনের শিক্ষকগণ ছাত্রদের এই গল্প শোনান।”
মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় পান, তাহলে জেনে নিন

আইন পেশা কি – প্রাচীন ব্যাবিলন ও আইনের জন্ম
আদিকালের ব্যাবিলন নগরী। তখন অ্যাসিরীয় সম্রাট নেবুচাদজান শাসন করতেন। তিনি শাসনকার্য সহজ করতে সাম্রাজ্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে মুরুব্বীদের নিয়ে ‘কাউন্সিল অব এল্ডার্স’ নিয়োগ করেন। এই কাউন্সিল রাজস্ব আদায়, পুলিশি ব্যবস্থা তদারকি এবং দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করত।
ব্যাবিলনের এক দরিদ্র ঘরের বধু ছিলেন সেই সুন্দরী সুজানা। তার রূপ-যৌবন ছিল কিংবদন্তী, আর চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ। সুজানার গ্রামের কাউন্সিল অব এল্ডার্সের দুজন বয়স্ক সদস্য তার রূপে মুগ্ধ হন এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
প্রতিদিন গোসলের সময় তারা গাছের আড়ালে লুকিয়ে সুজানাকে দেখতেন। একদিন সুযোগ বুঝে তারা সুজানাকে কুপ্রস্তাব দেন। সুজানা দৃঢ়তার সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিৎকার করে ওঠেন। অপমানিত বৃদ্ধরা তখন সুজানাকে হুমকি দিয়ে পালিয়ে যান।
ভায়েগ্রা আবিস্কারের মজার কাহিনী পড়ুন

প্রথম উকিল, প্রথম ক্রস এক্সামিনেশন
কাউন্সিল অব এল্ডার্স প্রতিশোধ নিতে সুজানার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আনলেন। সেই সময় বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ এক হওয়ায় এবং কাউন্সিলররা নিজেরাই সাক্ষী হওয়ায় সুজানার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া সহজ হয়ে গেল। তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী, ব্যভিচারী নারীকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে হত্যা করা হতো। সুজানার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হলো।
হাজার হাজার লোকের বিশাল সমাবেশ। পাথর ছোড়া শুরু হবে, এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক চিৎকার করে উঠল— “থামুন, থামুন!”
সেই যুবকের নাম ছিল দানিয়েল। জনতার উল্লাস ছাপিয়ে তার কণ্ঠস্বর সবার কানে পৌঁছাল। দানিয়েল দাবি করলেন, তিনি দুই সম্মানিত কাউন্সিলরকে প্রকাশ্য সমাবেশে প্রশ্ন করতে চান, তবে দুজন কে একসাথে নয়— আলাদাভাবে। জনতা আনন্দ ধ্বনি দিয়ে তাকে সমর্থন দিল।
দানিয়েল প্রথম বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কখন এবং কোথায় সুজানাকে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখেছেন?” প্রথম বৃদ্ধ উত্তর দিলেন: “সেদিন ছিল চাঁদনী রাত, একটি গাছের নিচে।”
এরপর দ্বিতীয় বৃদ্ধকে সামনে আনা হলো এবং তাকে একই প্রশ্ন করা হলো। দ্বিতীয় বৃদ্ধ উত্তর দিলেন: “দিনের আলোয় একটি মাঠের মধ্যে।”
সাক্ষ্যের এই অসঙ্গতি প্রকাশ হওয়ায় জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। মিথ্যা সাক্ষ্য ও অভিসন্ধির অভিযোগে দুই বৃদ্ধকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। এই ঘটনাই ফৌজদারি বিচারের সাক্ষ্য গ্রহণ ব্যবস্থা এবং সাক্ষীদের জেরা (Cross-examination) পদ্ধতির গোড়াপত্তন করে।
ঐতিহাসিকগণ, আইন বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং বিচারকরা এই দানিয়েলকেই মানবজাতির প্রথম উকিল বলে মনে করেন।
কিশোর কিশোরীরা কেন আত্মহত্যা করে

গ্রিস ও রোমে ওকালতির প্রসার
প্রাচীন গ্রিসে, বিশেষ করে এথেন্স নগরীতে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ওকালতি পেশা স্বীকৃতি লাভ করে। গ্রিক সভ্যতার পুরো সময় উকিলরা মক্কেলদের কাছ থেকে কোনো টাকা বা ফি নিতেন না। উপহার গ্রহণও অপরাধ বলে গণ্য হতো। তারা ওকালতিকে মানবসেবার সুযোগ মনে করতেন।
সময় পেরিয়ে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র যখন রোম হলো, তখন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের পরিধি বহু গুণ বাড়ল। কিন্তু আইনজীবীরা তখনও হাত পেতে টাকা নিতেন না।
সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে উকিলরা লম্বা এবং কালো গাউন পরা শুরু করেন। এই গাউনের পিছনে, ঘাড়ের নিচে ছোট পকেট থাকত। ক্লায়েন্ট খুশি হলে উকিলের অজান্তে সেই পকেটে স্বর্ণমুদ্রা রেখে দিতেন। এভাবেই ওকালতি পেশাটি ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে এবং ১২১৫ সালে বিখ্যাত ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষরের পর বিচারক এবং আইনজীবীরা আরও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হন।
কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলন কবে থেকে শুরু

আইন পেশা কি মহৎ পেশা
পৃথিবীতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আইন পেশাটি যে মহৎ চিন্তা থেকে শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে সরে এসে আজ পুরোটা ব্যবসায়িক রূপ নিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে এটি প্রতারণাতেও রূপ নিয়েছে। এ কারণেই নানা গল্প প্রচলিত আছে।
যেমন: এক উকিল তার পুত্রকে ব্যারিস্টারি পড়তে ব্রিটেনে পাঠিয়েছিলেন। পুত্র পড়া শেষ করে বাবার ল ফার্মে যোগ দেয় এবং তার বাবার বহু পুরোনো একটি দেওয়ানি মামলা প্রথম দিনেই নিষ্পত্তি করে ফেলল।
খাবার টেবিলে উচ্ছ্বসিত পুত্র যখন মাকে বলল, “মা জান, আব্বা যে দেওয়ানি মামলাটা নিয়ে দশ বছর যাবত ভুগছিলেন, আজকে আমি সেটা নিষ্পত্তি করে ফেললাম।”
বাবা খাওয়া বন্ধ করে বললেন, “ওরে বোকা! ওই মামলার টাকায় তোমাকে বিলেত পাঠিয়েছি। পড়াশোনার খরচ পাঠিয়েছি। তুমি সেখানে থেকেছ, খেয়েছ, ব্যারিস্টারি পাস করেছ। এই মামলাটা ছিল বলেই বেঁচে গেছি।”

সময় বদলেছে, কিন্তু আইনের ভিত্তি ও উদ্দেশ্য এখনও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। আইন পেশায় সফল হতে হলে মেধা, সততা ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
ব্লগ পোস্টটি ভালো শেয়ার করে দিন সেলিম হোসেন – ৩১/৮০৭/২০২৫ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া









