অটোইমিউন ডিজিস আপনার শরীরের গোপন যুদ্ধ
শরীর কি “শত্রু” হয়ে দাঁড়াচ্ছে? পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি—অটোইমিউনিটি!
ফাংশনাল ডিসপেপসিয়া-এর মতো, আজ আমরা এমন এক “রহস্যময় গোলযোগের” মুখোশ উন্মোচন করব, যা আসলে শরীরের ভেতরের এক নীরব যুদ্ধের গল্প!
বাইরে থেকে আপনি হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু ভেতরে চলছে এক গুরুতর অভ্যন্তরীণ সংঘাত। চিন্তা করবেন না, এটি কোনো সায়েন্স ফিকশন নয়! এটি হলো—অটোইমিউনিটি (Autoimmunity)।
সহজ কথায় অটোইমিউন ডিজিস কী?
শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ‘ইমিউন সিস্টেম’-এর কাজ হলো বাইরের শত্রু (যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া) থেকে আপনাকে রক্ষা করা। কিন্তু অটোইমিউন রোগে, এই প্রতিরক্ষা বাহিনী ভুল করে শরীরের নিজস্ব সুস্থ কোষ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ‘শত্রু’ মনে করে আক্রমণ করা শুরু করে দেয়!
ভাবুন, বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী (ইমিউন সিস্টেম) যদি ভুল করে পরিবারের সদস্যকে (শরীরের সুস্থ কোষ) ডাকাত ভেবে গুলি চালাচ্ছে! ঠিক এমনটাই ঘটে অটোইমিউনিটির ক্ষেত্রে।
ফ্যাট ওজন কমানোর সহজ উপায় জেনে নিন

গোপন যোদ্ধা: অটোইমিউনিটির লক্ষণগুলো চিনুন!
এই রোগের লক্ষণগুলো খুবই ধোঁয়াশা হতে পারে, যার কারণে প্রায়শই মানুষ ভাবে, “এগুলো তো সবারই হয়!” কিন্তু যদি এই লক্ষণগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত:
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি: এমন এক ক্লান্তি, যা ঘুম বা পর্যাপ্ত বিশ্রামেও দূর হয় না।
- জয়েন্ট পেইন ও ফোলা: গাঁটে ব্যথা এবং সকালে শক্ত হয়ে থাকা (যেমন: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস)।
- ত্বকের সমস্যা: অদ্ভুত র্যাশ, লালচে ভাব বা ত্বকের পরিবর্তন (যেমন: লুপাস)।
- হজমের গণ্ডগোল: পেট ব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য—যা কিছুতেই ভালো হচ্ছে না (যেমন: ক্রোন’স ডিজিজ)।
- মাঝে মাঝে জ্বর: কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই হালকা বা আবৃত্ত জ্বর অনুভব করা।
আসল কাহিনী: কেন পেটই এই যুদ্ধের ‘কেন্দ্র’?
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, অটোইমিউন রোগের রহস্যের প্রায় ৭০% উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের পেটের মধ্যে! পেট শুধু খাবার হজম করার জায়গা নয়। এটি হলো ইমিউন সিস্টেমের ‘ট্রেনিং সেন্টার’ এবং প্রধান নিয়ন্ত্রক।
পেট কীভাবে অটোইমিউনিটির জন্ম দেয়, চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ৪টি প্রধান কারণ:
১. পেটের প্রাচীরের দুর্বলতা (Leaky Gut/Intestinal Permeability)
পেটের ভেতরের প্রাচীর একটি শক্তিশালী ফিল্টারের মতো কাজ করে। এটি উপকারী জিনিসকে রক্তে শোষণ করে এবং ক্ষতিকর জিনিসকে আটকে দেয়। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাবার, অতিরিক্ত চাপ বা কিছু ওষুধের কারণে এই প্রাচীর দুর্বল হয়ে তাতে ফুটো তৈরি হতে পারে। যাকে বলা হয় লিকি গাট।
এই ফুটো দিয়ে হজম না হওয়া খাবারের কণা, টক্সিন এবং ব্যাকটেরিয়ার অংশ রক্তে প্রবেশ করে। ইমিউন সিস্টেম এগুলোকে ‘বহিরাগত শত্রু’ মনে করে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধই ধীরে ধীরে অটোইমিউনিটির জন্ম দিতে পারে।
২. অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম (Gut Microbiome)
পেটে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ‘বন্ধু’ ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, যারা কেবল হজমেই সাহায্য করে না, ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যদি খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায় (ডিসবায়োসিস), তবে তা ইমিউন সিস্টেমকে আরও বেশি উত্তেজিত করে তোলে। একটি সুষম মাইক্রোবায়োম অটোইমিউনিটির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ঢাল তৈরি করতে পারে।
মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া ভালো করার উপায়

৩. আণবিক নকল (Molecular Mimicry)
এটি অটোইমিউনিটির একটি মজার (এবং একই সাথে ভয়ঙ্কর) কৌশল!
অনেক সময়, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিনের গঠন আপনার শরীরের নিজস্ব সুস্থ কোষের প্রোটিনের গঠনের সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়। ইমিউন সিস্টেম যখন ভাইরাসটিকে আক্রমণ করে, তখন ভুল করে সে আপনার শরীরের সেই ‘নকলকারী’ সুস্থ কোষগুলোকেও আক্রমণ করে বসে ! এটিই অটোইমিউনিটির সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
৪. ওষুধ ও অন্ত্রের ক্ষতি
দীর্ঘদিন ধরে কিছু সাধারণ ওষুধ (যেমন: নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা NSAIDs এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক) ব্যবহার করলে তা আপনার পেটের বন্ধু ব্যাকটেরিয়া ও অন্ত্রের প্রাচীরের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
- বিপদ: অ্যান্টিবায়োটিক যেমন খারাপ ব্যাকটেরিয়া মারে, তেমনি উপকারী ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে। এটি মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং প্রদাহ (ইনফ্ল্যামেশন) বাড়িয়ে অটোইমিউনিটির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
৫. ভিটামিন ‘ডি’-এর ভূমিকা: ইমিউন সিস্টেমের ‘রিমোট কন্ট্রোল’
ভিটামিন ‘ডি’ কে শুধু হাড়ের জন্য ভাবলে ভুল হবে! এটি ইমিউন সিস্টেমের ‘রিমোট কন্ট্রোল’-এর মতো কাজ করে।
সংযোগ: গবেষণায় দেখা গেছে, অটোইমিউন রোগীদের একটি বিশাল অংশের শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি থাকে। পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘ডি’ ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে সাহায্য করে, যা অটোইমিউনিটির তীব্রতা কমাতে পারে। সূর্যের আলো হলো এর সবচেয়ে সহজ ও প্রাকৃতিক উৎস!
হলুদ চায়ের অসাধারন উপকারিতা জেনে নিন

রোগ নিরাময়ের ‘গেম প্ল্যান’: সফটওয়্যার ফিক্সিং!
ফাংশনাল ডিসপেপসিয়া-এর মতোই, অটোইমিউনিটির সমাধানেও জীবনযাত্রার পরিবর্তনই আসল চাবিকাঠি। আপনার পেটের পরিবেশ ঠিক করুন, আপনার ইমিউন সিস্টেম শান্ত হবে।
- খাদ্যতালিকা পরিবর্তন: প্রদাহ সৃষ্টিকারী খাবার (যেমন প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত চিনি) এড়িয়ে চলুন।
- ভিটামিন ডি: পর্যাপ্ত সূর্যের আলো গ্রহণ করুন এবং প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট নিন।
- স্ট্রেস কমানো: দীর্ঘস্থায়ী চাপ পেটের প্রাচীরকে দুর্বল করে। মেডিটেশন বা যোগাভ্যাস করুন।
অটোইমিউন ডিজিস নিয়ে ডাঃ এরিক বারগের ভিডিও দেখুন

উপসংহার
অটোইমিউনিটি একটি কঠিন যাত্রা হতে পারে। কিন্তু এটিকে আপনার জীবনের শেষ কথা মনে করবেন না। শরীর, মন এবং পেটের সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পারলে, এই নীরব যুদ্ধ জয় করা সম্ভব। শরীরকে তার প্রাপ্য বিশ্রাম দিন। তাকে পুষ্ট করুন। এবং মনে রাখবেন, আপনার কষ্টটা বাস্তবতা।
সচেতন হোন, আপনার পেটের কথা শুনুন, এবং ভেতর থেকে নিরাময়ের পথে হাঁটুন!
Reference: Dr Eric Berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.

