আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানুষের সামনে কথা বলা
বাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে। মাগরিবের সময় হয়ে এল প্রায়। এ বছর বৃষ্টি টা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে হচ্ছে। দু বন্ধু মুখোমুখি বসে আছে। অফিস বয় রাজু, সুন্দর করে কাটা এক প্লেট আম দিয়ে গেল। কাটা চামচে গেঁথে নিয়ে এক টুকরো মুখে দিয়ে ‘ আম তো বেশ সুস্বাদু’। বলল বেলাল আহমেদ
হুম, আর দামও তুলনামুলক কম। জাহিদ ইসলাম বলল
কিন্ত আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত আছি। কিছুটা ভয় হচ্ছে।
কি রাজনীতি ? বেলাল বলল
না, ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ব্যবসায়িক সেমিনারে আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিতে হবে। কি বলব ? বলতে গিয়ে গলা আটকে যাবে কিনা। নানান চিন্তায় বুক ধরফর করছে। আচ্ছা, তুই তো ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিস। বিভিন্ন সেমিনারে কথা বলিস। আমি কি করতে পারি ?
হ্যা, ১৬ টি উপায় আছে মানুষের সামনে কথা বলার। আমটা শেষ করি, তারপর বিস্তারিত টিপস তোকে জানাচ্ছি।
মানুষের সামনে কথা বলার সময় ভয়ে থাকেন আনুমানিক ৭৫ ভাগ মানুষ। যারা সুবক্তা, ভালো বক্তা তারাও জীবনের প্রথম বক্তব্যে ভয় পেয়েছেন, ঘেমেছেন, কাঁপাকাঁপি করেছেন। তাই ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ব্রিটেনের এক এম পি তার প্রথম সংসদীয় বক্তব্যে কি কাণ্ড করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত বক্তা হয়ে উঠেন। সেই কাহিনী শোনাব। তোকে কি করতে হবে, শোন।
জানেন কি, কোন অভ্যাস গুলো মানুষকে সফল করে

মানুষের সামনে কথা বলার টিপস
১. প্রয়োজনীয় প্রস্ততি
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির কে একবার সাংবাদিক রা জিজ্ঞেস করেছিল ” কাজে সফলতার উপায় কি ?” প্রয়োজনীয় প্রস্ততি গ্রহন করা, মাহাথির উত্তর দিলেন।
তোর বক্তব্য সবার থেকে ভালো হবে যদি প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিতে পারিস। কথা বলতে গিয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন থাকবে। আর ভুলের সংখ্যা কমে যাবে।
- যে হল রুমে সেমিনার সেখানে সময় হাতে নিয়েই পৌঁছে যাবি।
- বক্তব্য লিখিত হলে আগের দিনেই প্রিন্ট আউট করে রাখতে হবে।
- বক্তব্যের কয়েক টা পয়েন্ট নির্ধারণ করবি, আর সে অনুযায়ী কয়েক রঙের কার্ড হাতে রাখতে পারিস। এতে করে পয়েন্ট গুলো খেয়াল থাকবে। অথবা একটু বড় করে পয়েন্ট গুলো লিখে হাতে কাগজ রাখা যেতে পারে।
- কারিগরি ত্রুটির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন সাউনড কমে যাওয়া, বা পর্দায় ছবি আসতে দেরি করা।
- প্রতিদিন বক্তব্য অনুশীলন করতে হবে।
২. আত্মবিশ্বাস এবং কাল্পনিক চিত্র
আত্মবিশ্বাস নিয়ে মঞ্চে যেতে হবে। মনে মনে কল্পনা করতে হবে, আমি বক্তব্য দিচ্ছি আর সেই বক্তব্য মানুষ দারুন উপভোগ করছে। বক্তব্যের মাঝে দর্শকরা উৎফুল্ল হচ্ছে। বক্তব্য শেষে পুরো হল তালিতে ফেটে পরছে। এই বিশ্বাস মনের মাঝে গেঁথে নিতে হবে। তাহলে ভয় কেটে যাবে। শব্দ গুলো হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসবে।
পর্ণগ্রাফির সর্বনাশ থেকে নিজেকে বাঁচান

৩. নার্ভের উপর নিয়ন্ত্রন
আয়োজক কমিটি কাকে আমন্ত্রন করেন ? যাকে তারা পছন্দ করেন। যার কথা শুনতে চান। যাকে সম্মানিত করতে চান। বিষয় টা মাথায় রাখতে হবে।
- বক্তব্যের আগের রাত থেকে ক্যাফেইন খাওয়া বাদ রাখতে হবে। যেমন কফি, চকলেট, অতিরিক্ত চা। এগুলো নার্ভকে উত্তেজিত করে। ব্রেইন কে নার্ভাস এবং অস্থির করে দিতে পারে।
- ঘুম থেকে উঠে পর্যাপ্ত পরিমানে ব্যায়াম করতে হবে। এতে করে শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণ হবে।
- গাড়িতে যেতে যেতে শোনা যেতে পারে ভালো বক্তাদের পডকাস্ট।
- বক্তব্য দেয়ার আগে চেয়ারে বসেই শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। এতে করে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন বাড়বে।
- নিজের চেহারায় হাসি হাসি ভাব রাখতে হবে।
৪. বিরতি নেয়া
প্রথম বক্তব্য। কথা গুলো দ্রুত বের হতে পারে। একারনে বিরতি নিতে হবে। কথার মাঝখানে ১৫/২০ সেকেন্ড করে বিরতি নিলে সমস্যা নেই। বরং দর্শক ভাববে, তুই বক্তব্য নিয়ে সিরিয়াস। এরপর আবারো বলে যাবি। এতে করে বক্তব্য সুন্দর হবে।

৫. অনুশীলন কাজে দিবে
হাতে যে কয়দিন সময় আছে, এ কয় দিন অনুশীলন করতে হবে। গলার স্বর সপ্রতিভ হবে।
- বক্তব্যের পয়েন্ট গুলো নিয়ে আয়নার সামনে দাড়াতে হবে। এরপর চোখের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য শুরু করতে হবে।
- এমন ভাবে কথা বলতে হবে, যেন দর্শকের সামনেই কথা বলছিস।
- শরীর এবং হাত পায়ের নড়াচড়া থাকবে কম।
- সুযোগ থাকলে অন্যদের সামনে অনুশীলন করা যেতে পারে। তারা ভুল ধরিয়ে দিতে পারবে।
- প্রাকটিস বক্তব্য, ভিডিও করবি এবং নিজেই দেখবি।
- বক্তব্যের সময় মনোযোগ ধরে রাখতে হবে।
৬. শারীরিক ভাষা
পেশাদার বক্তারা দারুন আত্মবিশ্বাসী থাকে। তাদের বক্তব্যের ঢং দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে।
- দর্শকদের দিকে চোখ রাখতে হবে। একেক সময় একেক দর্শকের চোখের দিকে তাকাতে হবে।
- নিজের পয়েন্ট গুলিতে জোর দিতে হবে। এসময় অঙ্গভঙ্গি করতে হবে।
- খোলা মঞ্চ থাকলে, মঞ্চের চারপাশে ঘোরাফেরা করতে হবে।
- যে কথা বলবি, তার সাথে নিজের মুখের ভাবের মিল রাখতে হবে।
- ধীরে ধীরে এবং স্থিরভাবে শ্বাস নিতে হবে।
- কণ্ঠস্বর সঠিক ব্যবহার করতে হবে।
বাবা মায়ের যে ভুল গুলো সন্তানকে বিপথে নেয়

৭. আবেগীয় বক্তব্য
বক্তব্য নিজের আবেগ কে মেশাতে হবে। কথার সাথে যদি আবেগ মিশে যায়, তাহলে দর্শক আকৃষ্ট হয়। যেমন – কোন ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কথা বলতে পারিস। তখন কতটা হতাশ ছিলি, অনুভূতি কতটা দুর্বল করেছিল। সে কথা বলতে পারিস। তোর আবেগের সাথে দর্শক একান্তভাবে মিশে যাবে।
৮. ধীরে ধীরে কথা বলা
মানুষ যখন নার্ভাস থাকে, তখন দ্রুত কথা বলে। বক্তব্যে দ্রুত কথা বললে, দর্শক ধরেই নিবে আমি নার্ভাস। তাই কথা ধীরে ধীরে বলতে। এতে করে বলার ধরন সুন্দর থাকবে, শব্দের পর শব্দ ঠিকমত বলা যাবে। বক্তব্য আন্তরিক হবে। দর্শকও শব্দ গুলো হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। তৃপ্তি পাবে।
৯. বক্তব্যের শুরু থেকে
প্রথম পাঁচ মিনিট শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার জন্য। তাদের কে তোর কথা শোনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তোর করা কোনও ব্যবসায়িক ভুল বা অতীতে জীবন ভালো যাচ্ছিল না। বক্তব্যের প্রথমেই এমন কথা বলা যাবে না।
মানুষ এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে, এমন কথা বলতে হবে। যেমন আমরা সকলেই ভুল করি এবং ব্যর্থতার সম্মুখীন হই। এতে করে শ্রোতার মনে তার নিজের ব্যর্থতার কথা চলে আসবে। শ্রোতা বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
সেরা বক্তা হতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেন

১০. ভার মুক্ত রাখা
একটা বিষয় সব সেমিনারেই থাকে। একজন থাকেন, যিনি সারা সেমিনারে ঘুরে বেড়ান। এর সাথে হাসি মুখে কথা বলেন। ওর সাথে দেখা করেন। করমর্দন করেন, তিনি চলতেই থাকেন। যদি নিজের কথা বার্তায় জড়তা আসে, শরীর ভার মনে হয়, তখন নিজেকে ভারমুক্ত রাখতে , ওই চলমান লোকটার দিকে তাকাতে হবে।
১১. বক্তব্যে অজুহাত
দাওয়াত পাওয়ার পরে কি ভেবেছিলি ? একটা সময় ভেবেছিলি, থাক বক্তব্যই দিব না। তাই না। কেন ভেবেছিলি বক্তব্য দিবি না, তা খাতায় নোট কর। কারন নেতিবাচক চিন্তা আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। তোর মন তোকে বলছিল, ‘ জাহিদ, মানুষের সামনে কথা বলা কাজটা তোর না।’
ভয় গুলো কে চিন্হিত কর। এরপর প্রাকটিস শুরু কর। ভয় গুলো খুব দ্রুত কেটে যাবে।
১২. দর্শকের জন্য বার্তা
ভালো বক্তারা তাদের কথায় দর্শককে একটা মেসেজ দেয়। তুই কোন মেসেজ টা দিতে চাস, সেটা ঠিক করতে হবে। আগে থেকেই ভাবতে হবে। বক্তব্য দেওয়ার সময় যে দর্শক আনমনা, বা ঘুমিয়ে পরে, তার দিকে তাকানো দরকার নেই। তার দিকে তাকালে নিজের মেসেজের কথা ভুলে যেতে পারিস।
১৩. ভালো বক্তার বৈশিষ্ট
অনেক ভালো ভালো বক্তা আছে। মানুষের সামনে কথা বলায় তাদের অনুকরন করা যাবেনা। ভালো বক্তা কিভাবে হাত নাড়ান, অঙ্গ ভঙ্গি করেন, চোখ ঘুরান সেটা অনুকরন করেন অনেকেই। এটা ভুল একদম ভুল। ভালো বক্তাদের রসবোধ, শ্রোতাদের প্রতি মমতা থাকে। এগুলো অনুসরন করলে ভালো। মনে রাখতে হবে অনুকরন নয়।
সহিংস মুভি আমাদের কি ক্ষতি করে

১৪. হাস্যরস
যারা ভালো বক্তৃতা করেন, তাদের বক্তব্যে হাস্যরস থাকে। কথার মাঝে শ্রোতাদের হাসির গল্প বলেন। এতে শ্রোতারা বক্তব্য শুনতে আরও আগ্রহী হয়ে উঠে। বক্তা আর শ্রোতার মাঝে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
তাই বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হাসির গল্প বলা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে খুব সাবধানতা দরকার। ভালো প্রাকটিস করতে হবে। যাতে করে গল্প বলতে গিয়ে ভুল না হয়। ভিন্ন মেসেজ শ্রোতাদের কাছে না যায়। শ্রোতারা আহত না হয়। নিরাপদ উপায় এবং এটি বিশ্বাস তৈরি করে কারণ এটি দর্শকদের সাথে আরও সম্পর্কিত।
১৫. ভয় নেই ভুল হতে পারে
মানুষের সামনে কথা বলায় সবাই ভুল করে। বক্তব্যের ভুল দর্শকদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তাই কথা বলতে ভুল হলে স্বীকার করা উচিত। ভুল স্বীকার দর্শকরা সবসময় ক্ষমার চোখে দেখে।
১৬. পরের বক্তব্যের প্রস্ততি
বক্তব্যের কোন কথার সমালোচনা হতে পারে। কোন ব্যাপার নয়। আমাদের দেখতে হবে, কোন কথা গুলো ইতিবাচক ছিল। এরপর সেগুলো নোট করতে হবে। পরবর্তীতে আবার কোন বক্তব্যে কাজে লাগবে। ভুল কম হবে। বক্তব্য আরও আকর্ষণীয় হবে।
নার্ভাসনেস কমে আসবে, মানুষের সামনে কথা বলায় আত্মবিশ্বাস বাড়বে। একটা কাহিনী বলতে চেয়েছিলাম। এখন সেই নতুন এমপির কাহিনীটা বলছি।
গল্পে বউকে কি বলেছিল অমিত, কেন বউ তাকে হাসপাতালে পাঠাল

ব্রিটেনের পার্লামেন্ট। এক নবাগত সদস্যকে ফ্লোর দিলেন স্পিকার। তিনি দাড়িয়ে গেলেন। প্রথমবার সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে তার হাত পা কাঁপতে লাগল। কোর্টের নিচ দিয়ে ঘাম ছুটছে। কথা বলতে গিয়ে তার ঠোঁট জিহ্বা সারা দিচ্ছিল না।
হঠাৎ তিনি বলতে শুরু করলেন – I conceive, I conceive, I conceive এই শব্দ দুটোর বেশি বলতে পারলেন না। চেয়ারে বসে পরলেন। conceive শব্দের দুটো অর্থ হয়। ধারনা করা এবং গর্ভধারণ করা।
অপর দলের একজন মহিলা সদস্য দাঁড়িয়ে গেলেন। মিঃ স্পিকার, আমরা মেয়েরা একবার conceive করেই বাচ্চা জন্ম দিতে পারি। কিন্ত সম্মানিত সদস্য, তিন তিন বার conceive করেই কিছুই পয়দা করতে পারলেন না। তার এই ব্যর্থতায় আমি খুব দুঃখিত।
সেলিম হোসেন – ১৫/০৭/২০২৫ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া