অর্ফিয়াস ও সফলতার শর্ত: কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন সুরের যাদুকর?
কে এই অর্ফিয়াস?
গ্রিক পুরাণের খ্যাতনামা চরিত্র অর্ফিয়াস (Orpheus) ছিলেন একজন নশ্বর মানব । যদিও কিছু কিংবদন্তী তাঁকে ডেমিগড বা অর্ধ-দেবতা হিসেবে উল্লেখ করে। তিনি ছিলেন অ্যাপোলো (মতান্তরে ওগ্রাস) এবং ক্যালিওপে-র পুত্র।
তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তাঁর সঙ্গীতের প্রতিভা। তাঁর বাদ্যযন্ত্র থেকে যে সুরের মূর্ছনা উঠত, তাতে কেবল মানুষই মুগ্ধ হতো না, আশপাশের পশুপাখি, এমনকি গাছপালা ও পাথরও সুরের জাদুতে স্তব্ধ হয়ে যেত। তিনি তাঁর বিখ্যাত সামুদ্রিক জলপরী স্ত্রী ইউরিডাইসকে (Eurydice) খুব ভালোবাসতেন।
তাঁদের বিবাহের পরপরই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আরেক নাবালক দেবতা অ্যারিস্টিয়াস ইউরিডাইসকে অনুসরণ করেন। পালাতে গিয়ে ইউরিডাইস সাপের কামড়ে মারা যান।
জীবনে সফল হতে পাওলো কোয়েল হো’র লেখা বইটি আপনাকে দারুন সাহায্য করবে

প্রেমের জন্য পাতালে যাত্রা
স্ত্রীকে হারিয়ে একদম মূষড়ে পড়েন। মনের দুঃখে তিনি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে করুণ সুরে গাইতে শুরু করেন। তাঁর বিরহ-কাতর গানের সুরে চারপাশ থমকে যায়। এই সময় তিনি এক দৈব নির্দেশ শুনতে পান: “তোমার স্ত্রীকে পাতালপুরীর দেবতা হেডেসের (Hades) কাছে নিয়ে যাও। তাহলেই তিনি জীবিত হয়ে উঠবেন।”
তিনি তাই করলেন। স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে তিনি পাতালপুরীতে প্রবেশ করলেন। তিনি দেবতা হেডেস এবং তাঁর স্ত্রী পার্সিফোনকে (Persephone) তাঁর বাদ্যযন্ত্রের জাদুকরী সুর শোনালেন। তার প্রেমের গভীরতা এবং তাঁর সঙ্গীতের মাধুর্যে দেবতা হেডেস মুগ্ধ হলেন।
দেবতা হেডেসের কঠিন শর্ত
দেবতা হেডেস অর্ফিয়াসের স্ত্রী ইউরিডাইসকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন। তবে একটি অত্যন্ত কঠিন শর্ত দিলেন:
“তুমি যখন তোমার জীবিত স্ত্রীকে নিয়ে পৃথিবীর দিকে ফিরে যাবে, তখন তুমি সামনে হাঁটবে এবং তোমার স্ত্রী পিছনে হাঁটবেন। পৃথিবীতে পৌঁছানো পর্যন্ত তুমি কোনোভাবেই পিছনে ফিরে তাকাতে পারবে না।”
অর্ফিয়াস এই শর্তে রাজি হলেন। ইউরিডাইস জীবিত হলেন, এবং তাঁরা পৃথিবীতে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করলেন।
মুনির খুকুর আলোচিত প্রেম এবং খুনের ঘটনা

অর্ফিয়াস কেন ব্যর্থ হলেন?
অর্ফিয়াস সামনে, আর ইউরিডাইস তাঁর পিছনে। পথ অত্যন্ত দুর্গম ও অন্ধকার। অর্ফিয়াস মাটির একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছেন। এমন সময় তাঁর মনে এক তীব্র সন্দেহ দানা বাঁধল:
-
ইউরিডাইস কি সত্যিই পিছনে আছে?
-
দেবতা যা বলেছেন, তা কি সত্য?
-
তিনি কি নিশ্চিত হতে পারবেন না?
এই সন্দেহ, অস্থিরতা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণে অর্ফিয়াস শেষ মুহূর্তে পিছনে ফিরে তাকালেন। আর যেই মুহূর্তে তিনি শর্ত ভঙ্গ করলেন, তাঁর স্ত্রী ইউরিডাইস ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। এবার চিরতরে।
অর্ফিয়াসের ব্যর্থতা থেকে আমাদের শিক্ষা
অর্ফিয়াস ব্যর্থ হয়েছিলেন কারণ তিনি লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি যখন সফলতার দোরগোড়ায়, ঠিক তখনই সন্দেহ, অস্থিরতা এবং তাৎক্ষণিক ফলাফল দেখার আকাঙ্ক্ষার কাছে হেরে গেলেন।
এই গল্প আমাদের বাস্তব জীবনের সফলতার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়:
সফলতা আপনার ইচ্ছার কাছে বন্দী, কিন্তু প্রক্রিয়াটির কাছে শর্তাধীন।
যদি আপনি অর্ফিয়াসের মতো ব্যর্থ হতে না চান, তবে আপনাকে অবশ্যই ‘পিছনে ফিরে না তাকানোর’ নীতি অনুসরণ করতে হবে।
-
স্বাস্থ্য ও জীবনধারা: আপনি দুই দিন স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেন, আবার দুই দিন বাজে খাবার খেলেন। আপনি নিয়মিত ব্যায়াম করছেন না বা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাচ্ছেন না। এই অনিয়ম হলো ‘পিছনে ফিরে তাকানোর’ মতো—যা আপনার দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য লক্ষ্যকে নষ্ট করে দেয়।
-
ক্যারিয়ার ও দক্ষতা: কোনো নতুন দক্ষতা শেখার বা কোনো বড় প্রজেক্ট শুরু করার পর কয়েক মাস পরই সন্দেহ আসা: ‘আমি কি সঠিক পথে আছি?’ বা ‘দ্রুত ফল পাচ্ছি না কেন?’—এই সন্দেহ আপনাকে অর্ফিয়াসের মতোই ব্যর্থ করবে।
গ্রিক মিথলজিতে রয়েছে চমকপ্রদ সব প্রেম কাহিনী

সফল হতে হলে:
- লক্ষ্যের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখুন: আপনার পরিকল্পনা বা প্রক্রিয়ার উপর সন্দেহ পোষণ করবেন না।
- ধীরে ধীরে অভ্যাস তৈরি করুন: হেলদি লাইফস্টাইল বা যে কোনো লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত ফলাফলের আশা না করে ধীরে ধীরে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলুন।
- শর্ত ভঙ্গ করবেন না: লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে নিয়ম বা রুটিন তৈরি করেছেন, তা কঠোরভাবে অনুসরণ করুন। ধীরে ধীরে অলসতা কেটে যাবে।
আপনার বয়স যাই হোক না কেন, যদি আপনি অর্ফিয়াসের মতো শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ না হতে চান, তবে চূড়ান্ত পরিণতি না আসা পর্যন্ত স্থির থাকুন। পিছনে ফিরে তাকাবেন না। অতীত কে নিয়ে ভাবা মানে কবর থেকে লাশ টেনে তোলা। তাহলেই আপনি পাবেন তারুণ্যদীপ্ত নতুন জীবন ও আকাঙ্ক্ষিত সফলতা।
লেখক: সেলিম হোসেন – তারিখ: ২৭/০১/২০২৪ ইং – প্রতীকী ছবিগুলো পেক্সেলস থেকে নেওয়া।

