হেলদি লাইফস্টাইল সুস্থ থাকার ৭ টি উপায় 7 points of healthy lifestyle

হেলদি লাইফস্টাইল

হেলদি লাইফস্টাইল: আজীবন সুস্থ থাকার ৭টি আবশ্যিক উপায়

বিলাসবহুল জীবন নয়, সুস্থ দেহই জীবনের আসল সফলতা

সেলিম হোসেন | ২৫-০৮-২০২৪ ইং

জীবনের শুরুতেই আমাদের শেখানো হয়: অনেক বড় হতে হবে—গাড়ি, বাড়ি, নাম, যশ—তবেই তো সফল মানুষ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ক্যারিয়ারের পথে নিরন্তর দৌড়। ধরুন, জীবনের সব লক্ষ্যই পূরণ হলো, কিন্তু আপনার শরীরটা মোটা থলথলে, হাই প্রেশার, ডায়াবেটিসসহ নানা রকম অসুখে জর্জরিত। বিছানা, ডাক্তার, টেস্ট আর ওষুধেই কাটছে দিন।

এই অবস্থায় কি বিলাসবহুল জীবন উপভোগ করা সম্ভব? সুন্দরী স্ত্রী কি মনে আনন্দ দিবে ? না। জীবন তখন হয়ে ওঠে এক অস্বস্তিকর বোঝা। একটাই জীবন, আর একে উপভোগ করার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আজীবন সুস্থ থাকা। শরীর সুস্থ থাকলে সব সমস্যা মোকাবেলা করা যায় অনায়াসে, এবং সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়।

পড়ুন – মোটা থলথলে শরীরকে কিভাবে সহজেই স্লিম ফিগার করবেন

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

সুস্থ জীবনযাপনের তিনটি দিক

একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বা ‘হেলদি লাইফস্টাইল’ শুধু শরীরচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর তিনটি অপরিহার্য দিক রয়েছে:

১. শারীরিক (Physical): সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম। ২. মানসিক (Mental): স্ট্রেস বা মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা এবং মনের প্রশান্তি। ৩. আত্মিক (Spiritual): জীবনের উদ্দেশ্য এবং গভীর সংযোগ অনুভব করা (যেমন নামাজ বা মেডিটেশন)।

যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং আপনি নিয়মিত ওষুধ খান, কিন্তু একই সাথে মানসিক চাপে থাকেন, তবে আপনার শরীর অতিরিক্ত কর্টিসল হরমোন তৈরি করবে। এই হরমোন হজমে বাধা দেবে, শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করবে এবং নানান সমস্যা তৈরি করবে। তাই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।

রিসার্চ পড়ুন – Gluten সাস্থ্যের কি কি ক্ষতি করে আমাদের

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

প্রধান বাধা: যে খাবারগুলো আমাদের অসুস্থ করে

সুস্থ থাকার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভুল খাদ্যাভ্যাস। কোন খাবারগুলো আমাদের অসুস্থ করছে, তা জানা এবং সেগুলো বর্জন করাই প্রথম ধাপ।

১. বর্জনীয় টক্সিক ও প্রক্রিয়াজাত খাবার

  • বাজে খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাদ্য (Processed Food), শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, কেক, বিস্কুট, চিপস, কোমল পানীয়, চানাচুর, পাউরুটি।
  • খাদ্য শিল্পের ৪টি টক্সিক উপাদান: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুযায়ী, কিছু খাদ্য পণ্য বিক্রি বাড়ানোর জন্য চারটি টক্সিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা আমাদের ক্ষুধা অনুভবের হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এগুলো হলো—MSG, পরিশোধিত আটা বা ময়দা, কর্ণ ফ্লাওয়ার সিরাপ এবং গ্লুটেন (Gluten)

কারনে অকারনে অনেকেরই মন খারাপ হয়। মন ভালো করার উপায় জেনে নিন

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

২. আটা বা ময়দা এবং গ্লুটেন

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গমের তৈরি কোনো খাবার খাবেন না। গম প্রায়শই জেনেটিক্যালি মডিফায়েড হয় এবং এতে গ্লুটেন থাকে। এটা হেলদি লাইফস্টাইলের খাবার নয়। আমেরিকান হেলথ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, ৯০ ভাগ রোগের কারণ গমের তৈরি খাবার। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ বা কিডনি রোগের মতো অসুস্থতায় ভুগলে গমের খাবার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত।

৩. চাষের মাছ, মাংস ও তেল

ফার্মের মাছ (পুকুর বা বায়োফ্লক্স পদ্ধতিতে চাষ করা), ফার্মের মুরগি, এবং গরুর মাংস—যা মোটাতাজা করতে স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়—তা এড়িয়ে চলুন। সয়াবিন বা দোকানে সহজলভ্য তেলে রান্না করা খাবারও খাবেন না।

৪. অম্লীয় (Acidic) vs ক্ষারীয় (Alkaline) খাবার

আপনার খাদ্যতালিকায় ৮০ ভাগ জুড়ে থাকবে ক্ষারীয় বা অ্যালকালাইন (Alkaline) খাবার (যেমন শাকসবজি, ফলমূল)। মাছ, মাংস, ডিম, দুধের মতো অম্লীয় (Acidic) খাবার কম খাবেন।

পড়ুন – আমেরিকার National institute of health blue zones lessons. 

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

ব্লু জোনস: পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ মানুষদের জীবন রহস্য

২৮৭২ জোড়া যমজের উপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন মাত্র ২৫% নির্ভর করে জিনের ওপর। বাকি ৭৫% নির্ভর করে হেলদি লাইফস্টাইলের ওপর। আপনার দাদা ১০০ বছর বেঁচেছিলেন মানেই যে আপনিও বাঁচবেন, এই ধারণা ভুল।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফেলো ড্যান বুয়েটনার (Dan Buettner) এবং তার সহকর্মীরা পৃথিবীর পাঁচটি অঞ্চল চিহ্নিত করেছেন। যেখানে মানুষ ৯০ থেকে ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সেও হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপমুক্ত থাকে। এই অঞ্চলগুলো ‘ব্লু জোনস’ নামে পরিচিত।

এই অঞ্চলের মানুষদের স্বাস্থ্যকর জীবনধারা থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো একই:

  • খাদ্যাভ্যাস: তাদের খাবারের ৯০ ভাগই হলো প্ল্যান্ট বেজড (সালাদ, শাকসবজি, শস্য দানা বা ডাল)। তারা এই খাবার থেকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেল পান।
  • পেট ভরে না খাওয়া: তারা পেট ৮০% পূর্ণ হলেই খাবার ছেড়ে উঠে যান।
  • শস্য ও বাদাম: তারা লাল বা বাদামি চালের ভাত এবং বাদামকে খুবই পুষ্টিকর খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন।
  • দৈনন্দিন পরিশ্রম: তারা কৃত্রিম ব্যায়ামাগারে না গিয়ে প্রতিদিন প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করেন (যেমন হাঁটা, বাগান করা)।

জেনে নিন – সঠিক ভাবে ফাস্টিং করার নিয়ম। ফাস্টিং করলে কি লাভ হয়

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

৭টি আবশ্যিক অভ্যাস: আজীবন সুস্থ থাকার মন্ত্র

ব্লু জোনসের শিক্ষা এবং আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তৈরি এই ৭টি অভ্যাস আপনার জীবনকে পাল্টে দিতে পারে।

১. পুষ্টিকর খাবার (Nutritious Food)

হেলদি লাইফস্টাইলের মূল ভিত্তি হলো সঠিক খাবার চেনা। হাতের কাছে থাকা এই খাবারগুলো নিয়মিত গ্রহণ করুন:

  • শাকসবজি (দেশি), দেশি ফলমূল।
  • দেশি মুরগি/হাঁস, দেশি মুরগি/হাঁসের ডিম, ভেড়া/ছাগলের মাংস, দেশি গরুর মাংস।
  • ঘি, মধু, মাখন, সব ধরনের বাদাম, ডাল বা শস্য দানা।
  • নদীর মাছ, সমুদ্রের মাছ।
  • মিষ্টি জাতীয় খাবারে দেশী চিনি বা লাল চিনি, গুড় বা নারকেল চিনি ব্যবহার করুন।

২. প্রোবায়োটিক (Probiotic)

পাকস্থলী সুস্থ রাখতে প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার অপরিহার্য। যেমন—টক দই, কিমচি, সাওয়ার ক্রাউট, ডার্ক চকোলেট, পনির এবং আপেল সিডার ভিনেগার।

৩. ব্রিদিং এক্সারসাইজ (Breathing Exercise)

মানসিক চাপ (স্ট্রেস) কমাতে শ্বাসের ব্যায়াম ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়। ইউটিউবে ‘উইম হফ মেথড’ বা ডাঃ উইলসের ‘৪-৭-৮ ব্রিদিং সেশন’ লিখে সার্চ করে নিয়মিত অভ্যাস করুন।

৪. নিয়মিত ব্যায়াম (Exercise)

সুস্থ থাকার কোনো বিকল্প নেই। অন্তত সপ্তাহে ৪/৫ দিন ৩০-৪০ মিনিট ব্যায়াম করুন। প্রতিদিন ভোরবেলায় হাঁটতে পারেন। মাংসপেশি সুগঠিত করতে সপ্তাহে ৩ দিন জিমে যাওয়া বা বাড়িতে ভারি ব্যায়াম করা ভালো।

৫. ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent Fasting)

নিয়মিত ফাস্টিং বা রোজা রাখলে সবধরনের রোগের নিরাময়ে সাহায্য হয়। লম্বা সময় ফাস্টিং করলে শরীর ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত করে। ১২ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ফাস্টিং-এর সময় বাড়ান।

হলুদ চায়ের উপকারিতা জানলে কোন খাওয়া ছাড়বেন না 

হেলদি লাইফস্টাইল
হেলদি লাইফস্টাইল

৬. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট (Stress Management)

মানসিক চাপ বা স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন। শ্বাসের ব্যায়াম, মেডিটেশন বা নিয়মিত নামাজ আদায় এক্ষেত্রে দারুণ কাজ দেবে। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করুন এবং সামাজিক মেলামেশা বাড়িয়ে দিন।

৭. সূর্যের আলো (Sun Exposure)

সূর্যের আলো শরীরে ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে অন্তত ৩০ মিনিট সূর্যের আলো গায়ে লাগানোর চেষ্টা করুন। সপ্তাহে কমপক্ষে ৩/৪ দিন এটি করুন।

আপনি যদি এই ৭টি নিয়মগুলো পালন করেন, তাহলে আপনার শরীরের ওজন সঠিক মাপে থাকবে। অসুখ-বিসুখ থাকলে তা সেরে যাবে, আর আপনি সুস্থ থাকবেন আজীবন।

হেলদি লাইফস্টাইল নিজে অনুসরণ করুন এবং লেখাটি সবাইকে শেয়ার করে অন্যদের উপকারে আসুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *