হৃদরোগের কারণ ও প্রতিকার: ভুল ধারণা এবং হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার উপায়
আমেরিকান ভেগান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এইচ জয় দিনশাহের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু (২০০০ সালের ৮ জুন) প্রচলিত একটি ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিল—যে কেবল লাল মাংস, ঘি বা তেল খেলেই হৃদরোগ হয়। দিনশাহ ভেজিটেবল খেতেন, মাছ-মাংস-ডিম সম্পূর্ণ পরিহার করতেন। তাহলে কেন তাঁর হার্ট অ্যাটাক হলো? এই ঘটনা প্রমাণ করে, হৃদরোগের আসল কারণ চর্বি নয়, বরং আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু উপাদান।
আসুন জেনে নিই, হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণগুলো কী এবং কীভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে এই ঝুঁকি কমানো যায়।
আপেল সিডার ভিনেগারের অসাধারন সাস্থ্য উপকারিতা

হার্ট অ্যাটাক কী এবং কেন হয়?
হৃদপিণ্ড বা হার্ট একটি পেশিবহুল অঙ্গ (Muscular Organ)। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য হার্টের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা দরকার।
হৃদপিণ্ডে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। সারা শরীর থেকে ডিঅক্সিজেনযুক্ত রক্ত প্রথমে ডান অলিন্দে (Right Atrium) এবং সেখান থেকে ডান নিলয়ে (Right Ventricle) যায়। এরপর রক্ত ফুসফুসে গিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বাম অলিন্দে (Left Atrium) ফিরে আসে এবং সেখান থেকে বাম নিলয়ে (Left Ventricle) যায়। এরপর হার্ট পাম্পের মতো কাজ করে সেই অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সারা শরীরে সরবরাহ করে।
হার্ট অ্যাটাক যেভাবে হয়
হৃদপিণ্ড তার নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অক্সিজেনযুক্ত রক্ত গ্রহণ করে করোনারি ধমনির (Coronary Artery) মাধ্যমে। প্রধানত তিনটি করোনারি আর্টারি রয়েছে। এই ধমনিগুলোর মধ্যে আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্লক তৈরি হলে হার্টের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে:
- আংশিক ব্লক (Partial Block): একে অ্যানজাইনা পেকটোরিস (Angina Pectoris) বলা হয়।
- সম্পূর্ণ ব্লক (Complete Block): একে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক বলা হয়।
হু হু করে বাড়ছে কিডনি রোগী বাঁচার উপায় কি

হার্ট অ্যাটাকের ৮টি মূল কারণ
গবেষণায় দেখা গেছে, এর মূল কালপ্রিট হলো শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ (Inflammation) তৈরি করা লাইফস্টাইল ফ্যাক্টরগুলো।
১. আল্ট্রা প্রসেসড ফুড (Ultra Processed Food): এটি হার্ট সমস্যার প্রধান আসামী। বার্গার, কেক, পিৎজা, চিকেন ফ্রাই, বিস্কুট, চানাচুর, সফট ড্রিঙ্ক, বা প্যাকেটজাত স্ন্যাকসের মতো প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরে প্রদাহ (Inflammation) তৈরি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।
২. ডায়াবেটিস: রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা ধমনির দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে হার্ট আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
৩. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা হার্টকে দুর্বল করে দেয় এবং ব্লক তৈরির প্রক্রিয়াকে দ্রুত করে।
৪. স্থূলতা (Obesity): শরীরের অতিরিক্ত ওজন হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
৫. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: কায়িক পরিশ্রম, হাঁটা বা নিয়মিত ব্যায়াম না করা, শুয়ে-বসে থাকা হার্টের স্বাস্থ্য দুর্বল করার অন্যতম কারণ।
৬. ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল: ধূমপান ধমনির দেয়ালকে শক্ত করে দেয় এবং অ্যালকোহল হৃৎপিণ্ডের পেশীকে দুর্বল করে। আজকাল কম বয়সীদের মধ্যে হার্ট অসুখের এটি একটি অন্যতম কারণ।
৭. দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: ক্রমাগত মানসিক চাপ, রাত জাগা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শরীরে কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ইনফ্ল্যামেশন বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
৮. ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন (Chronic Inflammation): শরীরের অতিরিক্ত ওজন না থাকা সত্ত্বেও যদি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ থাকে (যেমন অটোইমিউন রোগ), সেক্ষেত্রেও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ও জরুরি করণীয়
হার্ট অ্যাটাক একটি গুরুতর জরুরি অবস্থা। সঠিক সময়ে লক্ষণ চিনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণসমূহ
- বুকে ব্যথা (Retro-sternal Pain): বুকের মাঝখানে (দুই বুকের মাঝের হাড়ের নিচে) তীব্র চাপ, ভার বা ব্যথার অনুভূতি। এটাই প্রধান ও সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ।
- ব্যথা ছড়িয়ে পড়া: বুকের ব্যথা বাম হাত, ঘাড়, চোয়াল, বা পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- শ্বাস কষ্ট: ব্যথার তীব্রতা বাড়লে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া এবং কাশি আসা।
- অতিরিক্ত ঘাম: প্রেশার কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
- বমি ভাব বা বমি: কারও কারও ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
- বুক ধড়ফড়: হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া বা অনিয়মিত হওয়া।
- জ্ঞান হারানো: তীব্র ব্যথার কারণে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় আর ডায়াবেটিস হবে না

হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়
১. তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিন: হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। দ্রুততম সময়ে রোগীকে নিকটস্থ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে বা জরুরি স্বাস্থ্য সেবার (যেমন: ৯৯৯) মাধ্যমে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
২. শান্ত থাকুন ও নড়াচড়া বন্ধ করুন: আক্রান্ত ব্যক্তিকে শান্ত রাখতে হবে এবং তার নড়াচড়া কঠোরভাবে সীমিত করতে হবে।
৩. অ্যাসপিরিন ও নাইট্রোগ্লিসারিন: * আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ (অ্যান্টি-প্লাটিলেট ড্রাগ) চিবিয়ে খেতে দিন, যা রক্ত তরল করে রক্ত প্রবাহে বাধা কমাতে সহায়ক। * যদি রোগীর পূর্বে হার্টের সমস্যা থাকে এবং চিকিৎসক নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তবে তাৎক্ষণিক অবস্থায় জিহ্বার নিচে ওই ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। অন্যদের ক্ষেত্রে নিজে থেকে এই ওষুধ দেওয়া যাবে না।
৪. সিপিআর (CPR): যদি রোগী জ্ঞান হারায় বা শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তবে দেরি না করে সঠিকভাবে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (CPR) দিতে হবে। (তবে যিনি সিপিআর দিতে জানেন, কেবল তিনিই দেবেন)।
যেভাবে ঔষধ ছাড়াই আজীবন সুস্থ থাকবেন

হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে ঔষধের চেয়ে জীবনযাত্রার পরিবর্তন (Lifestyle Modification) বেশি কার্যকর।
১. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: * আল্ট্রা প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত চিনি, এবং বাজে ফ্যাট সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করুন। * স্বাস্থ্যকর চর্বি (ঘি, বাটার, নারিকেল তেল, অলিভ ওয়েল) পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করুন। * হলুদ, গোলমরিচ এবং নারকেল তেলের মতো প্রদাহরোধী উপাদান আপনার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন।
২. শারীরিক সক্রিয়তা: নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা বা কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটুন।
৩. ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ: আজ থেকেই ধূমপান এবং মদ্যপান পুরোপুরি ছেড়ে দিন।
৪. ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: * রাতে দ্রুত ঘুমাতে যান এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। * যোগা, মেডিটেশন বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করুন।
৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ওষুধ খান।
নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসই হলো হৃদরোগ থেকে আজীবন সুস্থ থাকার মূল মন্ত্র।
লবন খেলে হার্ট এ্যাটাক হয় ? কি বলছেন ডাঃ জেসন ফং

পোস্টটি সবাইকে শেয়ার করতে পারেন। কারন এখন ক্লাস নাইনের মেয়েও হার্ট অ্যাটাক করে। সেলিম হোসেন – তাং ২১-০৮-২০২৫ ইং – প্রতীকী ছবি গুলো পেক্সেলস থেকে নেয়া
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.









