রাসেলস ভাইপারসহ বিশ্বের ১০টি সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ: এক নীরব আতঙ্ক
সাপ বা সর্প শব্দটি শুনলেই অনেকে আঁতকে ওঠেন। ভয় পাওয়ার কারণও আছে—কিন্তু বেশিরভাগ সাপই শান্ত, ভীত এবং বিষহীন। তবে কিছু সংখ্যক প্রজাতি আছে, যাদের কামড়ে মানুষ বা অন্য প্রাণীর জীবনহানি ঘটে। সাধারণত এরা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ করে। সম্প্রতি মিডিয়ার কারণে রাসেলস ভাইপার সাপ (Russell’s Viper) বাংলাদেশের মানুষের মনে তীব্র ভয়ের সঞ্চার করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৬০০টিরও বেশি প্রজাতির বিষাক্ত সর্প রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২০০টি প্রজাতি মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। কোনো কোনো সাপের কামড়ে শরীরের মাংস পচে যায়, আবার কোনো কোনোটির ছোবলে মৃত্যু অনিবার্য।
আসুন, রাসেলস ভাইপার সহ পৃথিবীর ১০টি ভয়ংকর বিষাক্ত সাপের পরিচয় এবং তাদের বাসস্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
স্ত্রীরা কেটে দিচ্ছেন স্বামীর পুরুষাঙ্গ, কিন্ত কেন ?

বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত ১০টি সর্পের পরিচিতি
১. বেলচেরি সি স্নেক (Hydrophis Belcheri)
অনেকে ইনল্যান্ড তাইপানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত বলে মনে করলেও, বাস্তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হলো বেলচেরি সি স্নেক। এটি ইনল্যান্ড তাইপানের চেয়েও প্রায় ১০০ গুণ বেশি বিষাক্ত।
- বাসস্থান: এটি সমুদ্রে বসবাসকারী।
- দৈর্ঘ্য: ০.৫ মিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
- বৈশিষ্ট্য: এটি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পানির নিচে থাকতে পারে।
- বিপদ: এই সাপ খুবই শান্ত স্বভাবের। তবে এর বিষাক্ত ছোবলে ১৫ মিনিটের কম সময়েই মৃত্যু ঘটতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম বিষ ১০০০ মানুষ বা ২.৫ লাখ ইঁদুর মারার জন্য যথেষ্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কামড়ালেও বিষ প্রবেশ করায় না।
২. ইনল্যান্ড তাইপান (Inland Taipan)
ভূমিতে বসবাসকারী সাপের মধ্যে ইনল্যান্ড তাইপান সবচেয়ে বিষাক্ত এবং ভয়ংকর প্রজাতির। এর বিষাক্ত ছোবলে একজন মানুষ সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকারও কোনো রেকর্ড নেই।
- দৈর্ঘ্য: ১.৮ মিটার থেকে ৩.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
- বিষ: এর কয়েক মিলিগ্রাম বিষ ১০০ লোক বা প্রায় ২.৫ লাখ ইঁদুর মারার জন্য যথেষ্ট। এক ছোবলে প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ নিক্ষিপ্ত হতে পারে।
- স্বভাব: এটিকে সবচেয়ে ভয়ংকর ধারণা করা হলেও এরা খুব সহজেই বশ মানে। বিরক্ত করা হলে শিকার জায়গা থেকে নড়ার আগেই এটি প্রচণ্ড বেগে কয়েক বার ছোবল দিয়ে দিতে পারে।
পড়ুন – এই মদ কেন এত সারা ফেলেছে মদ্যপদের কাছে।

৩. ক্রেইট সাপ (Krait)
তাইপানের পর ক্রেইট হলো মাটিতে বসবাসকারী বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত সাপ।
- বাসস্থান: এদের এশিয়ায় পাওয়া যায়।
- দৈর্ঘ্য: ৯০ সেন্টিমিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়।
- বিপদ: এরা যেকোনো সাধারণ কোবরা থেকে প্রায় ১৫ গুণ বেশি বিষাক্ত। দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও রাতের বেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের স্লিপিং ব্যাগ, বুট বা তাঁবুর নিচে লুকিয়ে থাকা এদের একটি সাধারণ অভ্যাস। ইন্ডিয়ান ক্রেইট ভারতে সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ।
৪. ফিলিপাইন কোবরা (Philippine Cobra)
মাটিতে বসবাসকারী বিশ্বের চতুর্থ সবচেয়ে বিষাক্ত সর্প এটি।
- দৈর্ঘ্য: প্রায় ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
- স্বভাব: এটি শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে ‘নাচতে’ পারে। ফিলিপাইনে সাপুড়েরা নাচ দেখানোর সময় এই কোবরাদের ব্যবহার করে।
- বৈশিষ্ট্য: সকল কোবরার মতো এরাও রেগে গেলে মাথার দুই পাশে ‘হুড’ দেখা যায়।
এক মাসে দশ কেজি ওজন কমাবেন, জেনে নিন উপায়।

৫. ইন্ডিয়ান কিং কোবরা (Indian King Cobra)
মাটিতে বসবাসকারী বিষাক্ত সর্পগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়ান কিং কোবরা পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ফিলিপাইন কোবরার পর এরাই সবচেয়ে বিষাক্ত।
- দৈর্ঘ্য: এরা সাধারণত ৩.৫ মিটার থেকে ৫.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। এটি বিশ্বের বিষাক্ত সর্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়।
- আক্রমণ: এরা মানুষকে তুলনামূলক কমই কামড়ায়। তবে কিং কোবরা ছোবলের সময় যেকোনো সর্প থেকে বেশি বিষ নিক্ষেপ করে।
- খাদ্য: এরা সর্পের খাদক হিসেবে পরিচিত। অবিষাক্ত সাপই এদের প্রধান খাদ্য, তবে ক্ষুধার্ত হলে অন্য বিষাক্ত সর্প, এমনকি নিজের প্রজাতিকেও খেয়ে ফেলে।
- প্রজনন: স্ত্রী কিং কোবরা এর ডিমের চারপাশে বাসা বাঁধে এবং বাসার কাছাকাছি কিছু এলে অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক আচরণ করে। এটি গভীর জঙ্গলের অধিবাসী।
৬. রাসেলস ভাইপার (Russell’s Viper)
ভয়ংকর দর্শন রাসেলস ভাইপার ভূমিতে বসবাসকারী বিশ্বের বিষাক্ত সর্পগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
- স্বভাব: রাসেলস ভাইপার খুবই রাগী ধরনের। সম্ভবত এটি অন্য যেকোনো বিষাক্ত সর্পের চেয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে।
- আক্রমণ: এটি কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং এত প্রচণ্ড বেগে শিকারকে ছোবল মারে যে, পালানোর কোনো উপায় থাকে না।
- বাসস্থান: এদের বিভিন্ন প্রজাতি খামারবাড়ি থেকে শুরু করে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত বসবাস করে।
- দৈর্ঘ্য: সাধারণত ১ মিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে।
- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে এর উপদ্রব বেড়েছে, বিশেষ করে চর এলাকার ক্ষেত-খামারে এরা কৃষককে আক্রমণ করছে।
ভিডিও দেখুন – কোলেস্টেরল নিয়ে এই গবেষণা আপনাকে চমকে দিবে।

৭. ব্ল্যাক মাম্বা (Black Mamba)
আফ্রিকার আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত এই সর্পটি ভূমিতে বসবাসকারী সবচেয়ে বিষাক্ত সর্পগুলোর মধ্যে সপ্তম।
- স্বভাব: এটি আক্রমণের জন্য খুবই কুখ্যাত এবং প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক। সাধারণ মানুষ এদের থেকে দূরে থাকে।
- গতি: এটি ভূমিতে বসবাসকারী সকল প্রজাতির মধ্যে দ্রুত গতির এবং ঘণ্টায় প্রায় ১৬ থেকে ১৯ কিমি যেতে পারে।
- দৈর্ঘ্য: এ প্রজাতি প্রায় ৪.৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
- বিপদ: এর কামড় থেকে শিকারের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।
৮. ইয়েলো জ-ড টমিগফ (Fer-de-Lance)
স্থানীয়ভাবে ফার-ডি-ল্যান্স নামে পরিচিত এ সর্পটি ভূমিতে বসবাসকারী সর্পগুলোর মধ্যে অষ্টম বিষাক্ত।
- স্বভাব: এরা প্রচণ্ড রাগী ধরনের এবং সামান্য উত্তেজিত করলেও প্রচণ্ড ছোবল মারতে পারে।
- বিপদ: এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর হার খুবই বেশি। এর বিষে মানুষের দেহকোষ এমনভাবে ধ্বংস হতে থাকে যে, শরীরে পচন দেখা দেয়।
- বাসস্থান: সাধারণত কৃষিজমি এবং খামারবাড়িতে এদের দেখা যায়।
- দৈর্ঘ্য: এরা গড়ে ১.৪ মিটার থেকে ২.৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
৯. মাল্টি-ব্র্যান্ডেড ক্রেইট (Multi-banded Krait)
এটি মাটিতে বসবাসকারী বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত সর্পের মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে।
- স্বভাব: সাধারণ ক্রেইটের মতো এরাও রাতের বেলা খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে।
- বাসস্থান: এদের সাধারণত জলাভূমিতে মাছ, ব্যাঙ বা অন্য সাপের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। চীন ও ফিজিতে এদের বেশি দেখা যায়।
- দৈর্ঘ্য: এরা গড়ে ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
সাপের কামড়ে বিশ্বে মিডিয়াতে হাসাহাসি, কিন্ত কেন ?

১০. টাইগার স্নেক (Tiger Snake)
টাইগার স্নেক ভূমিভিত্তিক বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত সর্পগুলোর মধ্যে দশম।
- বাসস্থান: এরা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী এক ধরনের সর্প যারা শরীরে প্রচুর পরিমাণে বিষ তৈরি করতে পারে।
- উপস্থিতি: এদেরকে শুষ্ক অঞ্চল, তৃণভূমি, জলাভূমি, মানববসতি সব জায়গাতেই দেখা যায়।
- দৈর্ঘ্য: এরা সাধারণত ১.২ মিটার থেকে ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
সাপের বৈজ্ঞানিক পরিচয়
বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, সাপেদেরকে প্রাণী জগতের, কর্ডাটা পর্বের, মেরুদণ্ডী উপপর্বের, সরোপ্সিডা শ্রেণির, আঁশযুক্ত স্কোয়ামান্টা বর্গের, সার্পেন্টেস উপবর্গের সদস্য বলে অভিহিত করা হয়। বৈজ্ঞানিক ও জেনেটিক পরিবর্তন অনুসারে গিরগিট থেকেই সাপের জন্ম, যার ইতিহাস প্রায় ১৫ কোটি বছরের মতো।
লেলিয়ান ফর্মুলা অনুসারে, একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সকল মহাদেশেই এদের উপস্থিতি দেখা যায়। পৃথিবীতে এদের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গ্রোফ ও ২,৯০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। সবচেয়ে ছোট থ্রেড সর্পের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে অজগর ও অ্যানাকোন্ডার সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট বা ৭.৬ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
তবে বেশিরভাগ প্রজাতির প্রাণী বিষহীন এবং যেগুলো বিষধর, সেগুলোও আত্মরক্ষার চেয়ে শিকার করার সময় বিষের প্রয়োগ করে।
সাপে ভয় পায় এমন বন্ধুকে পোস্টটি শেয়ার করে দিন। লেখক: সেলিম হোসেন তারিখ: ০৪/০৯/২০২৪ ইং

