মানুষের সামনে কথা বলার ভয় কাটানোর ১৬টি কৌশল: আত্মবিশ্বাস অর্জনের পথ
বৃষ্টি ভেজা আড্ডা
বাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মাগরিবের সময় হয়ে এল। দুই বন্ধু মুখোমুখি বসে আছে। অফিস বয় রাজু এক প্লেট সুন্দর করে কাটা আম দিয়ে গেল।
“আম তো বেশ সুস্বাদু,” বলল বেলাল আহমেদ।
“হুম, আর দামও তুলনামূলক কম,” জাহিদ ইসলাম বলল। “কিন্তু আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত আছি, কিছুটা ভয়ও হচ্ছে।”
“কী নিয়ে? রাজনীতি?” বেলাল হাসতে হাসতে জানতে চাইল।
“না, রাজনীতি নয়। একটি ব্যবসায়িক সেমিনারে আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিতে হবে। কী বলব? বলতে গিয়ে গলা আটকে যাবে কিনা— নানান চিন্তায় বুক ধরফর করছে। আচ্ছা, তুই তো ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিস, সেমিনারে কথা বলিস। আমি কী করতে পারি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই! মানুষের সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলার জন্য ১৬টি কার্যকর উপায় আছে। আমটা শেষ করি, তারপর বিস্তারিত টিপস তোকে জানাচ্ছি।”
মানুষের সামনে কথা বলার সময় আনুমানিক ৭৫ ভাগ মানুষ ভয়ে থাকেন। এমনকি যারা আজ সুবক্তা, তারাও জীবনের প্রথম বক্তৃতায় ভয় পেয়েছেন, ঘেমেছেন, আর কাঁপাকাঁপি করেছেন। তাই ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
জানেন কি, কোন অভ্যাস গুলো মানুষকে সফল করে

আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ১৬টি কার্যকর উপায়
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে একবার সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাজে সফলতার উপায় কী?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা।” তোর বক্তব্য সবার থেকে ভালো হবে যদি তুই নিচের প্রস্তুতিগুলো নিতে পারিস।
প্রস্তুতিমূলক কৌশল (Preparation Techniques)
১. প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি
- বক্তব্যের লিখিত রূপ: তোর বক্তব্য লিখিত হলে আগের দিনেই প্রিন্ট আউট করে রাখবি।
- পয়েন্ট কার্ড ব্যবহার: বক্তৃতার কয়েকটি মূল পয়েন্ট নির্ধারণ করবি এবং সে অনুযায়ী কয়েক রঙের কার্ড হাতে রাখবি। এতে করে পয়েন্টগুলো খেয়াল থাকবে।
- কারিগরি ত্রুটির জন্য প্রস্তুতি: সাউন্ড কমে যাওয়া বা পর্দায় ছবি আসতে দেরি করার মতো কারিগরি ত্রুটির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- অনুশীলন: প্রতিদিন কমপক্ষে একবার করে বক্তব্য অনুশীলন করতে হবে।
২. আত্মবিশ্বাস ও কাল্পনিক চিত্র
- সফলতার কল্পনা: মঞ্চে যাওয়ার আগে মনে মনে কল্পনা করবি— তুই বক্তব্য দিচ্ছিস এবং মানুষ তা দারুণ উপভোগ করছে। বক্তব্য শেষে পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ছে। এই বিশ্বাস মনের মাঝে গেঁথে নিতে হবে। তাহলে ভয় কেটে যাবে এবং শব্দগুলো হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসবে।

৩. নার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণ
- ক্যাফেইন বর্জন: বক্তৃতার আগের রাত থেকে কফি, চকলেট, অতিরিক্ত চায়ের মতো ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ রাখবি। এগুলো নার্ভকে উত্তেজিত করে ব্রেইনকে নার্ভাস ও অস্থির করে দিতে পারে।
- ব্যায়াম ও এন্ডরফিন: ঘুম থেকে উঠে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যায়াম করবি। এতে শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণ হবে, যা মনকে শান্ত রাখবে।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম: বক্তব্য দেওয়ার আগে চেয়ারে বসেই শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। এতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
- ইতিবাচকতা: নিজের চেহারায় হাসি হাসি ভাব রাখতে হবে।
পরিবেশন কৌশল (Delivery Techniques)
৪. বিরতি নেওয়া প্রথম বক্তৃতার সময় কথা দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে। তাই কথার মাঝে মাঝে ১৫-২০ সেকেন্ডের বিরতি নিতে হবে। এতে দর্শক ভাববে তুই বক্তব্য নিয়ে সিরিয়াস এবং তোর বক্তব্য আরও সুন্দর হবে।

৫. নিয়মিত অনুশীলন হাতে যে ক’দিন সময় আছে, অনুশীলন করবি। গলার স্বর সপ্রতিভ হবে।
- আয়নার সামনে অনুশীলন: বক্তৃতার পয়েন্টগুলো নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা অভ্যাস করবি।
- ভিডিও রেকর্ডিং: অনুশীলন বক্তব্য ভিডিও করবি এবং নিজেই দেখে ভুল শুধরে নিবি।
- মনোযোগ: বক্তব্যের সময় মনোযোগ ধরে রাখতে হবে।
৬. শারীরিক ভাষা (Body Language) পেশাদার বক্তারা আত্মবিশ্বাসী থাকেন। তাদের অঙ্গভঙ্গি দর্শকদের মুগ্ধ করে।
- আই কন্টাক্ট: দর্শকদের দিকে চোখ রাখবি। একেক সময় একেক দর্শকের চোখের দিকে তাকাতে হবে।
- অঙ্গভঙ্গি: গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলিতে জোর দিতে অঙ্গভঙ্গি করবি।
- মঞ্চে হাঁটা: খোলা মঞ্চ থাকলে মঞ্চের চারপাশে ঘোরাফেরা করবি।
- মুখের ভাব: যে কথা বলবি, তার সাথে নিজের মুখের ভাবের মিল রাখবি।
বাবা মায়ের যে ভুল গুলো সন্তানকে বিপথে নেয়

৭. আবেগীয় বক্তব্য বক্তব্যে নিজের আবেগ মেশাতে হবে। যেমন— কোনো ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কথা বলতে পারিস, তখন কতটা হতাশ ছিলি, সেই অনুভূতি বলতে পারিস। তোর আবেগের সাথে দর্শক একাত্ম হবে।
৮. ধীরে ধীরে কথা বলা মানুষ নার্ভাস থাকলে দ্রুত কথা বলে। দ্রুত কথা বললে দর্শক ধরে নেবে তুই নার্ভাস। তাই কথা ধীরে ধীরে বলতে হবে। এতে বলার ধরন সুন্দর থাকবে এবং দর্শকও শব্দগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।
৯. বক্তব্যের শুরু প্রথম পাঁচ মিনিট শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই নিজের করা কোনো ব্যবসায়িক ভুল বা অতীতের খারাপ জীবন নিয়ে কথা বলা যাবে না। এমন কথা বলতে হবে, যা মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। যেমন: “আমরা সকলেই ভুল করি এবং ব্যর্থতার সম্মুখীন হই।” এতে শ্রোতারা বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হবে।
সেরা বক্তা হতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেন

১০. ভার মুক্ত রাখা সেমিনারে যে লোকটি হাসি মুখে ঘুরে বেড়ায়, তার দিকে তাকাতে পারিস। কথা বলার সময় জড়তা বা শরীর ভার মনে হলে ওই চলমান লোকটির দিকে তাকাতে হবে।
১১. অজুহাত চিহ্নিত করা বক্তৃতার দাওয়াত পাওয়ার পর কেন তুই ভেবেছিলি যে বক্তব্য দিবি না? সেই নেতিবাচক চিন্তাগুলো খাতায় নোট কর। ভয়গুলোকে চিহ্নিত কর এবং তারপর অনুশীলন শুরু কর। ভয়গুলো খুব দ্রুত কেটে যাবে।
১২. দর্শকের জন্য বার্তা (Takeaway Message) ভালো বক্তারা তাদের কথায় দর্শককে একটি নির্দিষ্ট বার্তা দেন। তুই কোন মেসেজটা দিতে চাস, সেটা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে। বক্তব্য দেওয়ার সময় যে দর্শক আনমনা বা ঘুমিয়ে পড়ে, তার দিকে তাকাতে হবে না।
১৩. ভালো বক্তার বৈশিষ্ট্য ভালো বক্তাদের অনুকরণ নয়, বরং তাদের রসবোধ এবং শ্রোতাদের প্রতি মমতা অনুকরণ করবি। অনুকরণ না করে নিজের স্টাইল তৈরি করবি।
সহিংস মুভি আমাদের কি ক্ষতি করে

১৪. হাস্যরস ভালো বক্তৃতায় হাস্যরস থাকে। কথার মাঝে শ্রোতাদের হাসির গল্প বললে শ্রোতারা আরও আগ্রহী হয়। তবে এক্ষেত্রে খুব সাবধানতা দরকার। গল্প যেন বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং শ্রোতারা যেন আহত না হয়। এটি দর্শকদের সাথে বিশ্বাস তৈরি করে।
১৫. ভুল হতে পারে, ভয় নেই মানুষের সামনে কথা বলায় সবাই ভুল করে। ভুল হলে স্বীকার করা উচিত। ভুল স্বীকার দর্শকরা সবসময় ক্ষমার চোখে দেখে। এতে তোর সততা প্রকাশ পাবে।
১৬. পরের বক্তব্যের প্রস্তুতি বক্তব্যের কোনো কথার সমালোচনা হলে ব্যাপার নয়। দেখতে হবে কোন কথাগুলো ইতিবাচক ছিল এবং সেগুলো নোট করতে হবে। ভুল কম হলে এবং বক্তব্য আকর্ষণীয় হলে নার্ভাসনেস কমে আসবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
গল্পে বউকে কি বলেছিল অমিত, কেন বউ তাকে হাসপাতালে পাঠাল

ব্রিটেনের এমপির গল্প
ব্রিটেনের পার্লামেন্ট। স্পিকার ফ্লোর দিলেন এক নবাগত সদস্যকে। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। প্রথমবার সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। ঘাম ছুটছে, আর কথা বলতে গিয়ে ঠোঁট-জিহ্বা কাজ করছিল না।
হঠাৎ তিনি শুধু বলতে শুরু করলেন— “I conceive, I conceive, I conceive” (আমি ধারণা করি)। এই দুটো শব্দের বেশি তিনি বলতে পারলেন না এবং চেয়ারে বসে পড়লেন।
‘Conceive’ শব্দের দুটো অর্থ হয়— ‘ধারণা করা’ এবং ‘গর্ভধারণ করা’।
অপর দলের একজন মহিলা সদস্য দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন: “মিঃ স্পিকার, আমরা মেয়েরা একবার ‘conceive’ করেই বাচ্চা জন্ম দিতে পারি। কিন্তু সম্মানিত সদস্য, তিন-তিন বার ‘conceive’ করেও কিছুই পয়দা করতে পারলেন না। তার এই ব্যর্থতায় আমি খুব দুঃখিত।”
পুরো সংসদ কক্ষ হাসিতে ফেটে পড়ল। সেই লজ্জিত নতুন এমপির নাম ছিল বেঞ্জামিন ডিসরায়েলি, যিনি পরবর্তীতে ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী ও সেরা বক্তা হিসেবে পরিচিত হন। তাই প্রথম ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না, বরং এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: সেলিম হোসেন তারিখ: ১৫/০৭/২০২৫ ইং









