ফ্যাটি লিভার মানে কি
ফুলহাতা শার্ট, জিন্স প্যান্ট পরে ইন করা। কিন্ত ভদ্রলোকের পেট সামনের দিকে বেশ ফুলে উঠেছে। নিতম্ব ছোট হয়ে গিয়েছে। কর্পোরেট অফিসের ছোট বড় বসদের এমন অবস্থা দেখা যায়। সাধারন মানুষের মাঝেও এমন দৃশ্য এখন হরহামেশা চোখে পরে। ধরেই নেয়া এমন অবয়বের ব্যাক্তি ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হওয়ার পথে। কোন সন্দেহ নেই।
ফ্যাটি লিভার চিকিৎসায় ব্যয়
সারা বিশ্বে ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ এই লিভার সমস্যায় আক্রান্ত। দেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রতি ৪ জনে একজন এই রোগে আক্রান্ত। দিনে দিনে এই সংখ্যা বাড়ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, আক্রান্ত একজন রোগীর হাসপাতালে একবার চিকিৎসা নিতে গড়ে খরচ হয় ১৬ হাজার ৮১০ টাকা। এই হিসাবে আক্রান্ত সাড়ে ৪ কোটি রোগীর প্রত্যেকে একবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
যা দেশের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের দ্বিগুণ। সাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে। শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে ফেলতে হবে। ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘হেপাটোলজি সোসাইটি’ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই পরামর্শ দিয়েছেন।
পেটের চর্বি ঝরানো খুবই সহজ, শুধু উপায় টা জানতে হবে।

ফ্যাটি লিভার কেন হয়
এটা ফ্যাট খাবার খেয়ে হয়েছে বিষয় টি এমন নয়। আমাদের কনভেনশনাল ডাক্তার রা বলেন ফ্যাট খাবেন না, গরুর মাংস খাবেন না। যত দোষ ফ্যাট আর গরুর মাংসের ! লিভার আমাদের প্রধান ডিটক্স অরগ্যান। এটি আমাদের শরীরের ম্যানেজার। পুরো শরীরের পুষ্টি, হরমোন, টক্সিসিটি সবকিছু ব্যালান্সে রাখে লিভার। প্রতিদিন ১৪০০০ কেমিক্যাল তৈরি করে বিভিন্ন ফাংশনের জন্য। শক্তি উৎপাদনের প্রধান অরগ্যান হচ্ছে লিভার। এটি ৩ থেকে পাঁচ পাউনড ওজনের হয়। বুকের নিচের দিকে বাম পাশে থাকে।
বিভিন্ন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলেও যকৃতে চর্বি জমতে পারে। ডায়াবেটিক বা রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা বেশি থাকলেও লিভারে ফ্যাট জমতে পারে৷ আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর অনেকে বংশগত কারণেও ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হতে পারেন।
শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার ধ্বংসের কারন গুলো জেনে নিন।

এই রোগ সাধারণত ২ ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার এবং আরেকটি হলো নন-অ্যালকোহলিক। অ্যালকোহলিক সাধারণত যাদের অ্যালকোহল পান করার করার অভ্যাস আছে নিয়মিত, তাদের হয়ে থাকে৷
অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার গ্রহন। অনেকের পেটে ইনফেকশন হয়। এটা আসে দীর্ঘস্থায়ী মেটাবলিক ইস্যু থেকে। ব্যায়াম না করা, সারাদিন ঘরে বসে থাকা বা অফিসে থাকা। আমরা জানি শরীরে গ্রহন করা কার্বোহাইড্রেট পুরোটা কাজে না লাগলে গ্লাইকোজেন হিসেবে জমা থাকে। এই গ্লাইকোজেন খরচ না হলে তিন দিন পর ফ্যাটে পরিনত হয়। এটা লিভারের গায়ে জমা হয়। যাকে ফ্যাটি লিভার হিসেবে জানি।
হেলদি খাবার গুলো সম্পর্কে সবারই জানা দরকার।

ফ্যাটি লিভার টেস্ট
ডাক্তাররা যে সব টেস্ট করান
লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT) – SGPT (ALT) / SGOT (AST) / এই এনজাইমগুলো বেড়ে গেলে এটি যকৃতের প্রদাহ বা ক্ষতির ইঙ্গিত দিতে পারে।
আলট্রাসনোগ্রাফি – সবচেয়ে সাধারণ এবং সহজ উপায়। লিভারে চর্বি জমার মাত্রা দেখা যায় (Grade ১,২,৩)।
ফাইব্রোস্ক্যান / ইলাসটোগ্রাফি – লিভার কতটা শক্ত (fibrosis/scarring) হয়েছে তা মাপে।
সিটি স্ক্যান / এম আর আই (কম ব্যবহার হয়) – আরও স্পষ্টভাবে লিভারে চর্বির উপস্থিতি ও গঠন দেখা যায়।
লিভার বায়োপসি (Liver Biopsy) – সবচেয়ে নির্ভুল কিন্তু ইনভেসিভ টেস্ট। সাধারণত গুরুতর ক্ষেত্রে করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা (Blood Tests) – Lipid Profile: কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা / Fasting Blood Sugar / HbA1c: ডায়াবেটিস আছে কি না / HBsAg, Anti-HCV – হেপাটাইটিস চেক করার জন্য

ফ্যাটি লিভার গ্রেড ১
এই রোগের প্রাথমিক এবং সবচেয়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য পর্যায়। যেখানে লিভারের কোষে অল্প পরিমাণে চর্বি জমা হতে শুরু করে। আর এ অবস্থাকেই আমরা বলি ফ্যাটি লিভার। এটা বিপদের প্রাথমিক সঙ্কেত। লিভারের এ অবস্থায় যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দ্রুত নিরাময় সম্ভব।
লিভারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ চর্বি জমা হলে তাকে গ্রেড ১ বলা হয়। যদি অবহেলা করা হয়, তাহলে এটি নীরবে আরও বাড়তে থাকে।
ফ্যাটি লিভার গ্রেড ২
১০ থেকে ২৫ শতাংশ জমা হলে গ্রেড ২ বলা হয়।
ফ্যাটি লিভার গ্রেড ৩
৩০ শতাংশের বেশি থাকলে গ্রেড ৩ বলা হয়।

ফ্যাটি লিভারের খাদ্য তালিকা
যে সব খাবার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এর কারন সেসব খাবার খাবেন না। যেমন ভাত, রুটি, দুধ। ডাল, আলু। খাবারের তেলটা অবশ্যই পরিবর্তন করবেন। খাঁটি সরিষার তেল, অলিভ ওয়েল, নারিকেল তেল খাবেন। খাবারের শুরুতে অবশ্যই একবাটি সালাদ খাবেন। এই রোগের পাশাপাশি যাদের হজম ক্ষমতা কম, তারা যখনই খাবার খাবেন, অবশ্যই ভিনেগার খাবেন। খাবারের সাথে লেবুর রস খাবেন। খাবারের একঘণ্টা আগে বা পরে বেকিং সোডা খাবেন।
এলার্জি থাকলে ব্যায়াম করবেন, গায়ে রোদ লাগিয়ে ব্যায়াম করবেন। ফাস্টিং করবেন, করল্লা বা এজাতীয় খাবার খাবেন। ভালো ঘুমানোর চেষ্টা করবেন। কিভাবে ভালো ঘুমাবেন জেনে নিন।
বেকিং সোডা কিভাবে খাবেন জেনে নিন।

ফ্যাটি লিভারের লক্ষন
১. টাইপ টু ডায়াবেটিস আছে যাদের ২. মেনোপজ শুরু হয়েছে এমন নারীদের ৩. যাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে গেছে ৪. শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা যাদের বেশি ৫. দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন যারা ।
ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় ৫ টি
১. খাবারে ক্যালরির পরিমাণ কমাতে হবে। যেমন ভাত, রুটি, মিষ্টি, কেক, বিস্কুট এজাতীয় আপাতত একেবারেই বন্ধ করে দিবেন। প্রতি বার খাবারের পূর্বে একবাটি সালাদ খাবেন। এরপর শাকসবজি খাবেন। নদীর মাছ, সমুদ্রের মাছ, ডিম এগুলো খাবেন। দোকানের প্যাকেটজাত যে কোন জুস, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড, মদ ইত্যাদি খাবেন না।
২. প্রতিদিন ব্যায়াম করবেন। অন্তত ৩০ মিনিট সময় রোদে কাটাবেন, এতে করে ভিটামিন ডি নিশ্চিত হবে। দৌড়, হাঁটা, জিম করার ফলে অতিরিক্ত ক্যালরি ব্যয় হবে। লিভারের গায়ে লেগে থাকা চর্বি ঝরে যাবে।
৩. অবশ্যই ফাস্টিং করবেন। এতে শরীরের কোষ গুলো রিসাইকেল হবে, ওজন নিয়ন্ত্রনে আসবে। লিভারের গায়ে লেগে থাকা চর্বি গলে গিয়ে শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে ব্যয় হবে। লিভার সতেজ হয়ে উঠবে।
৪. আপনি যদি সঠিক ভাবে নিয়ম একমাস অনুসরণ করতে পারেন। ফলাফল আপনাকে আনন্দে উদ্বেলিত করবে।
৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি হেলদি লাইফ স্টাইল অনুসরণ করবেন।

আমরা এই লিভারের এই সমস্যা থেকে মুক্তির ন্যাচারাল উপায় গুলো জানলাম। লিভারের এই রোগ কি ভালো হয় ? আশাকরি এই প্রশ্নটি আর করবেন না।
সেলিম হোসেন – তাং ২৩/১০/২০২৪ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.