দাম্পত্য জীবন ধ্বংস করে যে ৫টি ‘ভাইরাস’
“বিয়ে নির্ধারিত হয় বেহেশতে, দুনিয়াতে শুধুমাত্র তা উদযাপিত হয়।”—এই বাক্যটি বিবাহের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব তুলে ধরে। মানুষে মানুষে তৈরি সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো দাম্পত্য জীবন। তবে আধুনিক জীবনযাত্রা, ব্যস্ততা এবং কিছু মারাত্মক বদভ্যাসের কারণে এই সম্পর্ক ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে উঠছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সুখী দম্পতিদের লোক-দেখানো ছবি দেখে অনেকে হাহুতাশ করেন, নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে হতাশ হন। বাস্তবতা হলো, ক্যামেরার পেছনের গল্পটি প্রায়শই ভিন্ন—হয়তো আপনার সম্পর্কটি তাদের চেয়ে অনেক সহজ ও স্বাস্থ্যকর। আসল বিপদ লুকিয়ে আছে আমাদের নিজেদের মধ্যে থাকা কিছু ‘ভাইরাস’-এ।
জেনে নিন – স্ত্রীর মন জয় করার ৮ টি উপায়

উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান: ভাঙছে শত শত সংসার
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। একটি উদাহরণ:
- শেরপুর জেলার চিত্র (জুলাই ২০২৩ – জুন ২০২৪):
- মোট বিবাহ নিবন্ধন: ৮,৭২০টি
- মোট তালাক নিবন্ধন: ৩,৮৪৪টি
- বিচ্ছেদের হার: ৪৪% (মোট বিবাহের প্রায় অর্ধেক)।
- শিক্ষিতদের মধ্যে প্রবণতা: সাধারণ মানুষের তুলনায় শিক্ষিতদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি।
- প্রেমের বিয়ে: পরিবারের অমতে বা কেবল প্রেম করে হওয়া বিয়েগুলো ভাঙছে বেশি। তবে, পারিবারিক সম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে হওয়া প্রেমের বিয়ে টিকে থাকার হার তুলনামূলকভাবে ভালো।
- অঞ্চলভেদে তারতম্য: শ্রীবরদী উপজেলায় ডিভোর্স হার সর্বোচ্চ (৫২.২৫%), এবং নালিতাবাড়িতে সর্বনিম্ন (৩৮.৬০%)।
এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, দরকার সঠিক পরিচর্যা ও সচেতনতা।
বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবাহের উপকারিতা
দুবাইয়ের রাজকুমারী শেখ মাহরা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম সম্প্রতি বিচ্ছেদের পর তার নতুন পারফিউমের নাম দিয়েছেন ‘ডিভোর্স’। এটি বিবাহবিচ্ছেদের প্রতি সমাজের পরিবর্তিত, কখনও কখনও উদাসীন, মনোভাবের একটি প্রতীকী উদাহরণ।
অন্যদিকে, জাপানসহ উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যা কমতে থাকার একটি প্রধান কারণ হলো বিয়ে ও সন্তান জন্মদানে অনীহা। মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ক্যারিয়ারে বেশি মনোযোগী হওয়ায় দাম্পত্য জীবনকে ‘ঝামেলা’ মনে করছে, যার ফলস্বরূপ দেশটির একের পর এক স্কুল বন্ধ হচ্ছে।
তবে সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বিবাহের উপকারিতার পক্ষে যুক্তি দেন। ব্রিটেনের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক (ONS) নিশ্চিত করেছে:
- যারা বিবাহিত, তারা ডিভোর্সড বা লিভ-টু-গেদার করা যুগলদের তুলনায় দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন।
- বিবাহিত যুগলদের সন্তানরাও শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশি শক্তিশালী হয় এবং শিক্ষা ও কর্মজীবনে ভালো ফল করে।

দাম্পত্য জীবন ধ্বংসকারী ৫টি ‘ভাইরাস’
আসুন জেনে নিই, কোন পাঁচটি অভ্যাস বা ‘ভাইরাস’ চুপিসারে আমাদের দাম্পত্য জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং কিভাবে তা এড়িয়ে চলা যায়।
১. তুলনা ভাইরাস (The Comparison Virus)
তুলনা দাম্পত্য সম্পর্কের অন্যতম বড় শত্রু। জীবনসঙ্গীর স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিতে না পারা এবং তাকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা এক ধরনের মানসিক নির্যাতন।
- ‘অমুকের স্ত্রী কত ভালো রান্না করে, আর তুমি শুধু মুরগির ঝোল জানো!’
- ‘আমাদের বসকে দেখেছ, কত স্মার্ট পোশাক পরে? তোমার পোশাক-আশাক আনস্মার্ট।’
এই ধরনের কথা সঙ্গীর আত্মমর্যাদাকে আঘাত করে এবং সম্পর্ককে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়। ভুলেও নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে অন্য কারও সাথে তুলনা করবেন না।
২. ঝগড়ায় জেতা ভাইরাস (The Need-to-Win Virus)
কেউই নিখুঁত নন। দাম্পত্য সম্পর্ক এগিয়ে চলে পারস্পরিক ছাড় ও সমঝোতার মাধ্যমে। ঝগড়ার সময় প্রতিবার জিততে চাওয়া মানে আসলে সম্পর্কটাকেই হারানো।
- ব্লেইম গেমকে বিদায়: কে দোষী, কার ভুল বেশি—এই বিতর্ক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দুজনেই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হোন।
- ঝগড়ার সময় কেউ একটু বেশি উত্তেজিত হলে বা খারাপ কথা বললে, আপনিই না হয় সেদিন ছাড় দিন। প্রতিবার জেতার চেষ্টা না করে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার উপর জোর দিন।

৩. তৃতীয় পক্ষ ভাইরাস (The Third-Party Virus)
দাম্পত্য সম্পর্ককে তৃতীয় পক্ষের প্রভাবমুক্ত রাখা আবশ্যক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সমাধান অন্য কোথাও খোঁজা চরম বোকামি।
- ঝগড়া বা মনোমালিন্য হলেই বাবা-মা, ভাই-বোন, অথবা সবচেয়ে ক্ষতিকর—পুরনো বন্ধু বা এক্স-এর কাছে ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলবেন না।
- সঙ্গীকে নিয়ে অন্যের কাছে ‘বিচার’ দিয়ে তাকে ছোট করবেন না। এতে আদতে আপনি নিজেই ছোট হবেন এবং নিজেদের জটিলতা আরও বাড়বে।
- তিক্ততা ভুলে একে অপরকে মন থেকে ক্ষমা করুন এবং নিজেদের ভেতরের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করুন।
৪. নীরবতা ভাইরাস (The Silence/Stonewalling Virus)
মনে জিদ চেপে রেখে বা অভিমানের বরফ জমিয়ে নীরব থাকাটা একসময় বড় ধরনের কলহ সৃষ্টি করে। ছোট ছোট বিষয়ে দ্বিমত হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কথা না বললে রাগ মনে জমা হতে থাকে।
- যখনই দ্বিমত তৈরি হয়, তা নিয়ে খোলা মনে আলাপ আলোচনা করুন।
- মনের রাগ ও অভিমান জমতে দেবেন না। আলোচনার মাধ্যমে সেই ‘রেড লাইন’ স্পর্শ করার আগেই সমস্যা মুছে ফেলুন।
শেষ কথা এবং রম্য গল্প
দাম্পত্য জীবনে ভালো থাকতে হলে এই পাঁচটি ‘ভাইরাস’ সম্পর্কে সচেতন হন। আপনার সৌন্দর্য কেবল আপনার চেহারা বা পোশাকে নয়, বরং স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল, মানসিক শান্তি এবং সম্পর্কের যত্নে। নিয়মিত একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, স্ট্রেস দূর করুন এবং গুণগত সময় কাটান।
পরিচিত অসুখী দম্পতিদের পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
সেলিম হোসেন – ২২/০৯/২০২৪ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী



