কারবালা – যে কাহিনী অজানা। Karbala – the story is unknown

কারবালা
কারবালা – যে কাহিনী অজানা। 

১০ই মহররম, ৬১ হিজরি  ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ। কারবালা প্রান্তর। থেমে গেছে আর্ত চিৎকার। রক্তে ভিজে কাদা হয়েছে শুকনো মাটি। কলকাকলি বন্ধ করে চুপ আছে পাখিরা। কারবালায় শোকে পাথর আহলে বাইয়াতের শিবির। নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর শিশু জয়নুল আবেদিন বেঁচে আছেন। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইন ( রাঃ ) এর শিশু পুত্র। আহলে বাইয়াত এর একমাত্র জীবিত পুরুষ।

শত শত বছর ধরে মুসলিমরা কারবালার শোক বয়ে চলেছে। এত মাতম, এত শোক প্রকাশ ইতিহাসের আর কোন ঘটনা নিয়ে নেই। কিন্ত সেই ঘটনার পরে আরও কি ঘটেছিল ? আমরা বেশিরভাগ মুসলিম সেটা জানিনা।

সবাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় দামেস্কে। অনেক দিন পর জয়নুল আবেদিন কে মদিনায় বাস করার অনুমতি দেয়া হয় শর্ত সাপেক্ষে। শর্ত ছিল তিনি কোন রাজনীতিতে জড়াবেন না। তিনি শর্ত পালনে সতর্ক ছিলেন। কোন বদনাম যেন না হয়। তার সুনাম ছড়িয়ে পরে মুসলিম বিশ্বে। তিনি মুসলিম দের স্বীকৃত ইমাম হয়ে উঠেন।

কারবালা

পড়ুন – মায়ের ভালোবাসা, মায়ের উদারতা।

কারবালার পরে জয়নুল আবেদিন কে হত্যা। 

হিসাম ইবনে আব্দুল মালিক তখন ক্ষমতায়। উমাইয়া শাসক। বিত্ত বৈভবের সীমাহীন প্রাচুর্য। বলা হয়ে থাকে খলিফা হিসামের সাম্রাজ্যের মত অত বড় আয়তনের রাষ্ট্র আর কোন শাসকের কপালে জোটেনি আজ পর্যন্ত।

একই বছরে হিসাম এবং জয়নুল আবেদিন হজ্ব করতে যান মক্কায়।

এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে কালো পাথরে চুমু খাওয়ার সময়। জনতা পরম শ্রদ্ধায় জয়নুল আবেদিন কে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে রাখেন। কালো পাথরে চুমু খাওয়া নির্বিঘ্ন করে দেন। অবাক হয়ে যান খলিফা হিসাম ইবনে আব্দুল মালিক। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। সব ফোকাস জয়নুল আবেদিনের দিকে। সাথে থাকা বিখ্যাত আরবি কবি ফারাজদাফ কে জিজ্ঞেস করেন, ” লোকটি কে। ফারাজদাফ কবিতার মাধ্যমে জয়নুল আবেদিনের পরিচয় দেন। কবিতা টি পরে বিখ্যাত হয়ে যায়।

রাজ ক্ষমতা টেকাতে ভীত হয়ে পড়েন খলিফা হিসাম। তিনি ভাবেন, জনগন কে সাথে নিয়ে যে কোন সময় বিদ্রোহ করতে পারেন জয়নুল আবেদিন। অথচ জয়নুল আবেদিন রাজনীতির ধারে কাছেও ছিলেন না। ঈর্ষা আর ভয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন হিসাম। কাবা শরীফের ঘটনার কিছুকাল পর, মহান এই আহলে বাইয়েতকে বিষপানে হত্যা করা হয়।

কারবালা

কারবালার পরে মোহাম্মাদ আল বাকির।

এরপর ইমাম নির্বাচিত হন মোহাম্মদ আল বাকির। তিনি জয়নুল আবেদিনের ছেলে। পিতার করুন পরিনতির কথা ভেবে তিনিও সদাসর্বদা সতর্ক থাকতেন। ক্ষমতাসীনদের সাথে বিরোধ হতে পারে এমন কাজ করতেন না। রাজনীতির ধারে কাছেও যেতেন না।

মুসলিম বিশ্বের মুমিন মুত্তাকি মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হতে থাকেন মোহাম্মদ আল বাকির। মানুষ স্রোতের মত তার কাছে আসতে থাকেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। একনজর ইমাম কে দেখার জন্য। শাসক কুলের মাথায় আগুন ধরে যায়। জনতা যেভাবে নদীর মত ” বাকির ” সমুদ্রের মোহনায় গিয়ে মিলছে। তাতে যে কোন মুহূর্তে বিদ্রোহ হতে পারে।

উমাইয়া খলিফা হিসাম তখনো ক্ষমতায়। তিনি তার ভাগ্নেকে দায়িত্ব দিয়ে মদিনায় পাঠান। ভাগ্নে ইব্রাহিম ইবনে ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল্লাহ সতর্কতার সাথে মদিনায় আসেন। খুব সুকৌশলে আততায়ী হিসেবে এগোতে থাকেন। তিনি মোহাম্মদ বাকির কে একটি বিষ মিশ্রিত ঘোড়ার জিন উপহার দেন। ঘোড়ার জিনে বসামাত্র মোহাম্মদ বাকির বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যায়। ইমাম মোহাম্মদ বাকির মৃত্যু বরণ করেন।

দেখুন – কারবালার ইতিহাস- আশুরা কি ? ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। 

কারবালা এরপর জাফর সাদিক।

কারবালার রেশ চলতেই থাকে। ইমাম মোহাম্মদ আল বাকিরের পর ইমাম হন তার ছেলে। পুরো নাম জাফর ইবনে মোহাম্মদ আল সাদিক। অতি অল্প সময়ের মধ্যে জাফর সাদিক মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা অর্জন করেন। তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে পড়েন। শিয়া, সুন্নি এমন কি খারেজিরা পর্যন্ত তাকে শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন। সবার আস্থা আর নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেন।

ইমাম জাফর সাদিকের প্রভাব প্রতিপত্তি যখন তুঙ্গে, তখন উমাইয়া খিলাফত মারাত্মক দুর্বল হয়ে পরে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়। যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেতনা, ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পরে। খলিফা বৃন্দ রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পরেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার পালাবদল, বিশৃঙ্খলা, বিদ্রোহ ঠেকাতেই শাসকদের সময় পার হয়। ইমাম জাফর সাদিকের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার সময় পান নি। মনযোগ দিতে পারেন নি ইমাম জাফর সাদিকের প্রতি।

এভাবে উমাইয়ারা নিয়তির ফাঁদে আটকা পরেন। আব্বাসিয়রা তাদের উপর হামলে পরেন। উমাইয়ারা পরাজিত এবং সমুলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

কারবালা

অল্প সময় ক্ষমতায় ছিলেন খলিফা আবুল আব্বাস আস সাফফাহ। চারিদিকে বিপ্লব, হানাহানি, খুনোখুনি, যুদ্ধ। এরই মাঝে ইমাম জাফর সাদিকের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পরেন আবুল আব্বাস। ইমাম কে গ্রেফতার করেন। পরে মুক্তি দেন। আব্বাসের মৃত্যুর পর খলিফা হন আল মনসুর। তিনি ইমাম জাফর সাদিক কে পুনরায় গ্রেফতার করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ইমামকে ছেড়ে দেন।

ইমাম জাফর সাদিক মদিনায় যে মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন, সেখানে প্রায় চার হাজার ছাত্র ছিল। ইমাম আজম আবু হানিফা, ইমাম মালিক ইবনে আনাস, ওয়াসিল ইবনে আতা জাফর সাদিকের ছাত্র ছিলেন।

অন্যদের মত খলিফা আল মনসুরও ইমাম জাফর সাদিক প্যানিকে ভুগতেন। ইমামের জনপ্রিয়তা, মানুষের উপর প্রভাবের কারনে নিজের পদ পদবী, সিংহাসনকে তুচ্ছ মনে হত আল মনসুরের। তিনি কাণ্ডজ্ঞ্যান হারিয়ে ফেললেন। রাজকীয় ফরমান জারি করলেন। ইমাম জাফর সাদিক কে মদিনা ছেড়ে রাজধানী বাগদাদ এসে বাস করতে। সবাই বুঝে ফেলল খলিফা চাইছেন ইমাম সাদিককে নজরবন্দী করতে।

ইমাম জাফর সাদিক অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি মদিনাতেই থাকতে চান। কিছুদিন পরে ইমাম নিজেই বাগদাদে এলেন। খলিফার সাথে দেখা করলেন। কিছুদিন থাকলেন। খলিফাকে বোঝাতে সমর্থ হলেন ” তিনি খলিফার জন্য হুমকি নন।” খলিফার অনুমতি নিয়ে ইমাম মদিনায় ফিরে এসে বসবাস করতে লাগলেন।

খলিফা আল মনসুর আবারও সাদিকের প্রতি ঈর্ষাকাতর ও সন্দিহান হয়ে পরেন। তিনি ইসলামের ইমাম প্রথাকেই সমুলে উচ্ছেদ করতে চাইলেন। তিনি চাইলেন খোলাফায়ে রাশেদিন জামানার মত ইমাম ও খলিফার পদে একজনই থাকবেন।

তিনি আততায়ী নিয়োগ করেন। হিজরি ১৪৮ সাল – ৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল মনসুরের আততায়ী সফলতা লাভ করেন। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় মুসলিম জাহানের প্রিয় ইমাম জাফর সাদিক কে। এরপর বহু ঘটনা পরিক্রমার পর ইমাম নিযুক্ত হন মুসা আল কাজিম। ইমাম জাফর সাদিকের ছোট ছেলে।

কারবালা

ভিডিও দেখুন – কারবালার বর্তমান পরিবেশ। 

কারবালা – মনসুরের পর আল মাহদি

খলিফা মনসুরের পর খলিফা নিযুক্ত আল মাহদি। তিনিও ইমামের সম্পর্কে একই ধারনা পোষণ করতেন। গ্রেফতার করে মুসা আল কাজিম কে রাজধান বাগদাদে নিয়ে আসেন। একদিন মাঝরাতে সপ্ন দেখেন হজরত আলী ( রাঃ ) কে । আলী ( রাঃ ) খলিফাকে বলছেন ” তুমি যদি রক্তের বন্ধন ছিন্ন কর। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কর। জমিনে পাপাচারে লিপ্ত হও। তবে তোমার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে প্রদান করা হবে। ভয়ংকর সপ্নে ঘুম ভাঙে খলিফার। তিনি উজির কে ডেকে পাঠান।

ভোর রাতে মুক্তি পেয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন মুসা আল কাজিম। উপহারের হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে প্রিয় শহরে ফিরেন। সময় নির্বিঘ্নে কাটছিল মুসা আল কাজিমের।

খলিফা আল মাহদির মৃত্যুর পর খলিফা হন চতুর্থ খলিফা নিযুক্ত হন আল হাদি। ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র একবছরের মাথায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হন হারুন আল রশিদ।

কারবালা

পড়ুন – কারবালার আরও করুন ইতিহাসের কাহিনী এবং আশুরার তাৎপর্য।

কারবালা – আল হাদির পর হারুন আল রশিদ।

খলিফা মদিনায় গিয়ে মুসা আল কাজিমের সাথে সরাসরি সাক্ষ্যাত করেন। তাদের মধ্যে বহু পারস্পরিক বিষয়ে আলাপ হয়। খলিফা মুসা আল কাজিমের ব্যাক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য, আধুনিকতায় মুগ্ধ হন। ইমাম খলিফাকে অভয় দেন। বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত সহকারে নিজের খলিফা হওয়ার দাবিকে অস্বীকার করেন।

খলিফা বাগদাগে ফিরে আসেন খলিফা। নিজের পরিবারে খলিফা আলোচনা করেন মুসা আল কাজিম কে নিয়ে। প্রশংসা করেন ইমামের।

এরপরেই খলিফা কে পূর্ববর্তি খলিফাদের রোগে ধরে। কুৎসা কারীরা খলিফাকে বলেন ” ইমাম বিদ্রোহের জন্য বাহিনী গঠন করছেন।” তার ভক্তরা তাকে অর্থ জোগান দিচ্ছেন। খলিফা হজ্ব শেষে নিজে মদিনায় গেলেন। মুসা আল কাজিম কে গ্রেফতার করলেন। ইমামের আধ্যাত্মিকতা কে ভয় পেতেন খলিফা। এক রাতে ভয়ংকর সপ্ন দেখলেন। ত্রিশ হাজার দিরহাম দিয়ে মুক্ত করে দিলেন মুসা আল কাজিম কে।

ইমাম কে দুনিয়া থেকে বিদায় করতে হারুন আল রশিদ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন। ৭৯৯ সালের ৪ ঠা সেপ্টেম্বর বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় মুসা আল কাজিম কে। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর।

কত বছর পার হয়ে গেল! এখনো কারবালা, কারবালা বলে শোকে কাতর হন মুসলিমেরা। কিন্ত কারবালার পরেও কি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *