ওমেগা৩ কেন খাবেন
ধরুন আপনার একটি গাড়ি আছে, সেটা চালাতে তেল লাগে। তবে গাড়ি চালাতে আরও একটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হল ইঞ্জিন ওয়েল। ইঞ্জিন ওয়েল গাড়িতে ঠিকমত ব্যাবহার করা হয় তাহলে গাড়ি ভাল থাকে, ভালভাবে চলে। তো, ওমেগা ৩ কেন খাবেন এ কথা কেন? আমাদের শরীর প্রায় ১০-৩৭ ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে তৈরি। এই কোষ শর্করা , চর্বি পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করে, এই শক্তিতেই আমরা চলচল করি।
প্রতি কোষের ভিতরে থাকে অনেক গুলো ইঞ্জিন, যেমন ঃ মাইট্রোকন্ডিয়া , লাইসোজম। এই ইঞ্জিন সচল থাকলে শরীরে প্রয়োজনীয় হরমোন, এনজাইম তৈরি হয়, দেহ সচল থাকে। মাইটরোকনডিয়া, লাইসোজম সচল রাখতে প্রতিদিন ইঞ্জিন ওয়েল হিসেবে ওমেগা ৩ প্রয়োজন। ওমেগা ৩ কেন খাবেন এটা ইঞ্জিন ওয়েল একটা উদাহরন।
আমরা জানি সম্পৃক্ত চর্বি হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ! তেল-চর্বিযুক্ত খাবার হৃদরোগীদের জন্য নিষেধ করেন ডাক্তাররা, কিন্ত গবেষণা বলে ভিন্ন কথা। সবরকম হেলদি চর্বি খেতে পারবেন। অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেতে বাঁধা নেই, বরং এটি রক্তে উপকারী চর্বির পরিমাণ বাড়ায় এবং দেহের নানা উপকার করে।
একমাসে কিভাবে অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলবেন।
ওমেগা৩ কি ? উপকারিতা কি ?
ওমেগা-৩ হলো এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। যা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড নামে পরিচিত। মানুষের শরীরের জন্য ফ্যাটি এসিড অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। আগেই বলেছি ইঞ্জিন ওয়েল।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আমরা যে সব স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করি তার মধ্যে বেশির ভাগ খাদ্যেই থাকে। এমনকি মাছের তেলের মধ্যে রয়েছে এই উপাদানটি। শরীরে এই উপাদানটির অভাব থাকলে দেখা দেয় একাধিক রোগ।
১. অনেকেরই প্রদাহের কারনে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য। উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রক্তনালিতে অস্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন-অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তনালিতে প্ল্যাক গঠন প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দেয়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড কোলন ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার এবং প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
২. নতুন প্রজন্ম অভ্যস্ত জাঙ্ক ফুডে। এই বাজে খাবারে ওমেগা ৩ নেই। একারনে বাচ্চা থেকে শুরু করে যুবক বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক কে দেখা যায় চশমা পরতে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের স্বাস্থ্য উন্নত করে, ভ্রূণের মস্তিষ্কে বিকাশে সক্ষম, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
ঔষধ ছাড়াই আজীবন সুস্থ থাকবেন কিভাবে।
৩. এছাড়া প্রদাহ/ইনফ্লামেশন কমাতে এই খাদ্য উপাদান টি গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রয়োজনীয় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিহত করে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়। হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এই খাদ্য উপাদান বিশেষ প্রয়োজনীয়।
৬. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ভাল কোলেস্টেরল বা এইচডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে।
৭. ফ্যাটি এসিড প্রধানত দুই প্রকার: এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড ও নন-এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড । এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড হলো সেই সমস্ত ফ্যাটি এসিড যা আমাদের শরীর তৈরি করতে পারে না । এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড আমরা খাবারের মাধ্যমে তা পেয়ে থাকি। অর্থাৎ ওমেগা৩ যুক্ত খাবার।
৮. অন্যদিকে নন-এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীর প্রস্তুত করে থাকে। ফ্যাটি এসিডগুলোর মধ্যে আমাদের শরীরের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।
শরীরে ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাবে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। চোখের শুষ্কতা, চোখে জ্বালা, জয়েন্টে ব্যথা কিংবা চুল পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিলে বুঝতে হবে শরীরে দেখা যাচ্ছে ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতি। তেমনই চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, চুলের শুষ্কতা, প্রদাহ ও অ্যালজেইমার রোগ হলে বুঝতে হবে শরীরে দেখা দিয়েছে ওমেগা৩ এর অভাব। সুস্থ থাকতে এবং উপরোক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে খাদ্য তালিকায় যোগ করুন নিচের খাবার গুলো।
কিডনি রোগী বাড়ছে হু হু করে, বাঁচার উপায় কি ?
কোন খাবারে ওমেগা ৩
সামুদ্রিক মাছ, স্যামন মাছ
উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাট ইপিএ এবং ডিএইচএ আছে স্যামন মাছে। এই বিশেষ চর্বি হৃদক্রিয়া উন্নত রাখতে ও প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। প্রদাহ কমে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যাওয়া। রক্ত চাপ ঠিক রাখতে সপ্তাহে দুই দিন স্যামন মাছ খাওয়া ভালো। স্যামন মাছ ভাজবেন না, ভাজলে পুষ্টিগুণ কমে যাবে। স্যামন মাছ তৈলাক্ত, তাই বেশি তেলে রান্নার প্রয়োজন নেই। বেকড, রোস্ট এমনকি সিদ্ধ করে স্যামন মাছ খান। এতে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। সামুদ্রিক অন্যান্য সব মাছেও ওমেগা ৩ আছে, তাই নিশ্চিন্তে সামুদ্রিক মাছ খান।
নদীর মাছে ওমেগা৩
ইলিশ মাছ এবং ইলিশ মাছের ডিম ওমেগা ৩ তে পরিপূর্ণ। এছাড়া পাঙ্গাস, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল সহ অন্যান্য তৈলাক্ত মাছে ওমেগা ৩ আছে।
গরুর দুধ
দুধ আমাদের দেশের সব খানেই পাওয়া যায়। অনেকেই নিয়মিত খেয়ে থাকেন। দেশি গরুর দুধ খাবেন, ফার্মের টা নয়। সরাসরি দুধে অনেকেরই হজমে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে দুধ দিয়ে টক দই তৈরি করে খেতে পারেন। এতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডও পাওয়া যায়। পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে প্রবায়োটিক পাবেন।
ফ্ল্যাক্সিড
আমাদের দেশে ‘ তিসি’ নামে পরিচিত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এর তেল খেতেন। ফ্ল্যাক্সিডকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আপনিও যদি এটি খেতে চান তাহলে এই বীজগুলোকে পিষে পাউডার তৈরি করুন বা এর বীজ দিয়ে লাড্ডু তৈরি করুন। তাতে অনেকটাই উপকার পাওয়া যাবে।
ডিম
অনেকেই সকালের নাশতায় ডিম খেয়ে থাকেন, যার কারণে সারা দিন শক্তি অটুট থাকে। এতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল। ডিম কুসুম সহ খাবেন, ওমেগা ৩ কুসুমেই থাকে।
আখরোট
ড্রাই ফ্রুটস অনেকেই খান। আর এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও খুব উপকারী। ড্রাই ফ্রুটসের মধ্যে আখরোটকে স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণই ভাল বলে মনে করা হয়। এটি খেলে আপনার শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের কোনও অভাব থাকবে না। তবে এক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখবেন। আখরোটের গরম প্রভাব রয়েছে। তাই গরমকালে আখরোট বেশি খাবেন না।
ওমেগা৩ ডিম সুপার সপে
আলাদা কিছু প্যাকেটে দেখা যায় এই ডিম গুলো সুপার সপের র্যাকে সাজানো। কিভাবে ডিম ওমেগা৩ যুক্ত হয়। ফার্মের মুরগীকে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো হয়। এই মুরগী থেকে পাওয়া ডিম ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ হয়। এই ডিম তৈরিতে ফার্মেই মুরগীকে তিসির বীজ খাওয়ানো হয়। এমনকি মাছের তেলও খাওয়ানো হয়। যার ফলে এসব মুরগী থেকে পাওয়া ডিম ওমেগা-৩ সম্পন্ন হয়ে উঠে।
কিন্ত একটা বিষয় আছে। ন্যাচারালি সব ডিমেই ওমেগা৩ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বাড়তি দাম দিয়ে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম খেতেই হবে এমন নয়। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, দাম নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, তারা চাইলে এই ডিম কিনতে পারেন। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি এটা মুলত ব্যবসায়িক একটি কৌশল, বেশি দামে ডিম বিক্রির জন্য।
বাদাম
সব ধরনের বাদামেই পাবেন ওমেগা৩, খেতেও সুস্বাদু। অতএব প্রতিদিন খাবারের তালিকায় এক মুঠ বাদাম রাখুন। সবচেয়ে বেশি পাবেন কাঠবাদামে।
ওমেগা৩ আর কোথায় পাওয়া যাবে
অনেক গুলো খাবারের নাম নির্দিষ্ট করে বলেছি। এছাড়াও এই খাদ্য উপাদান চিয়া সিড, সয়াবিন, সবুজ পাতাওলা সবজি ইত্যাদিতে পাবেন।
দেখুন – খারাপ কোলেস্টেরল ঘরোয়া ভাবে দূর করার ৫ উপায়।
এবারে একটি মজার কথা শোনাই। খেতে বসে প্লেটের সবটুকু খাবার শেষ করে দেন ? চেটেপুটে খান ? আমি কিন্ত চেটেপুটেই খাই। ভালো লাগে। খাবারের শেষ লোকমা টা বেশ স্বাদের হয়। প্লেটে লেগে থাকা অংশ আরও স্বাদের। সুস্বাদু এই অংশ টুকু খেতে পারলেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এমন ধারনা আফ্রিকার জুলুদের।তাই আফ্রিকার জুলুরা খাবারের শেষ লোকমা খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি শুরু করে। কিন্ত শেষ লোকমা খেতে বা চেটেপুটে খেতে চীনের হাইনানবাসিরা ভয় পান। তাদের বিশ্বাস শেষ লোকমা খাওয়া মানে সৌভাগ্যকে দূরে ঠেলে দেয়া। সৌভাগ্য দূরে চলে যাওয়ার ভয়ে তারা সবসময়ই খাবারের শেষ লোকমা প্লেটে রেখেই উঠে যান।
উপরের আলোচনা আশাকরি বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। এই ভিটামিন টি আমাদের সবার জন্য অতি প্রয়োজন। তাই সবার সাথে শেয়ার করতে পারেন পোস্টটি।
সেলিম হোসেন – তাং ১৮/০১/২০২৪ ইং – ছবি গুলো প্রতীকী।
Reference : Dr Eric berg, Dr Mujibul Haque, Dr Jahangir Kabir, Dr Mujibur Rahman, Dr Mandell, Dr Jason Faung, Dr Sten Ekberg and many medical health journals.