পরকীয়া এবং সুখের খোঁজ: পাওলো কোয়েলহোর ‘অ্যাডাল্টরি’ উপন্যাসে বিলাসিতা ও শূন্যতা
লিন্ডা, যিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বাস করেন, আপাতদৃষ্টিতে তাঁর জীবনে সবকিছুই আছে। বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি, সম্মানজনক চাকরি, অঢেল অর্থ, ফুটফুটে দুই সন্তান এবং একজন বিশ্বস্ত, সফল স্বামী। তবুও, লিন্ডা হাঁপিয়ে উঠেছেন। জীবন তাঁর কাছে মনে হচ্ছে বৈচিত্র্যহীন, পানসে। ভেতরে বইছে এক গভীর শূন্যতা। কিন্তু প্রাচুর্যের মাঝেও এই শূন্যতা কেন?
আমাদের অনেকেরই একটি বদ্ধমূল ধারণা থাকে যে, টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি ও একজন ভালো সঙ্গী থাকলেই জীবনে সুখে থাকা যায়। বিশ্বখ্যাত লেখক পাওলো কোয়েলহো তাঁর ‘অ্যাডাল্টরি’ (Adultery) উপন্যাসে সেই ধারণাকেই প্রশ্ন করেছেন। ‘দি আলকেমিস্ট’ বা ‘মাক্তুব’-এর মতো বইগুলোতে যেমন তিনি মানুষের জীবনের গভীরতম দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি এই উপন্যাসটিতেও তিনি দেখিয়েছেন আধুনিক জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানসিক জটিলতা।

উচ্চবিত্তের জীবন: সাফল্যের আড়ালে শূন্যতা
উপন্যাসটি সমাজের উঁচু শ্রেণীর (Elite Class) যাপিত জীবনের এক কঠিন চিত্র তুলে ধরে। এরা সেই মানুষ, যারা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করেন এবং যাদের জীবন নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর কৌতূহল ও গুজব প্রচলিত। কিন্তু তাদের সংসারের অন্দরে কী ঘটে? পাওলো কোয়েলহো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেখিয়েছেন যে, প্রাচুর্য বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা জীবনের সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। বরং আধুনিক, ব্যস্ত জীবনযাত্রায় আমরা একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখতে ভুলে যাই, যার ফলে সবার বুকের ভেতরেই বাড়তে থাকে এক অদৃশ্য শূন্যতা।
জীবনে যারা সফল হতে চান তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য পৃথিবীব্যাপী বেস্ট সেলার বই ” দি আলকেমিস্ট ” বইটি।

পরকীয়া: বেঁচে থাকার ‘অবৈধ সুখ’
লিন্ডা একজন সংবাদপত্র অফিসে চাকরি করেন। তাঁর স্বামী দেশের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। বিয়ের দশ বছর পর, তাঁর জীবনে আসে এক অপ্রত্যাশিত মোড়—তাঁর পুরনো প্রেমিক জ্যাকব। জ্যাকব এখন একজন বড় মাপের রাজনীতিবিদ, এবং লিন্ডার দায়িত্ব পড়ে তাঁর একটি নির্বাচনপূর্ব সাক্ষাৎকার নেওয়া।
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে পুরনো আবেগ ফিরে আসে। লিন্ডা যদিও জ্যাকবকে দূরে সরিয়ে দেন, মনে করিয়ে দেন যে তাঁরা এখন আর সেই স্কুল জীবনের ছেলে-মেয়ে নন, তবুও সেই ক্ষণিকের আকর্ষণ তাঁর মনোজগতে এক প্রবল নাড়া দেয়। এই ঘটনা লিন্ডাকে এক ভিন্ন পথে চালিত করে।
উপন্যাসের সেই মুহূর্তগুলোতে লেখক দেখিয়েছেন, লিন্ডার কাছে শারীরিক সম্পর্কটি কেবল যৌনতা ছিল না, এটি ছিল নিয়মের শৃঙ্খল ভাঙার এক মরিয়া চেষ্টা। এটি ছিল সেই ‘অবৈধ সুখ’ যা তাঁকে দীর্ঘদিনের বৈচিত্র্যহীন জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন, “আমি নিয়ম ভাঙতে পেরেছি এবং সারা পৃথিবী আমার দিকে উপুর হয়ে চেয়ে নেই।” এই অভিজ্ঞতা তাঁকে সাময়িকভাবে ‘সাহসী’ এবং ‘সুখী’ মনে করিয়েছিল—যেন তিনি এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন, এবং এখন অবশেষে জেগে উঠেছেন।
বই পড়লে মস্তিস্কে কি পরিবর্তন হয় জেনে নিন। বলছেন ফিলোসফার আহসান আজিজ সরকার।

মনোজগতে জটিলতা এবং মুখোশ
‘অ্যাডাল্টরি’ উপন্যাসটি কেবল পরকীয়ার গল্প নয়। এটি উচ্চবিত্তের যৌন জীবন, রাজনৈতিকদের মুখোশ এবং আত্ম-উপলব্ধির এক জটিল আখ্যান। লেখক দেখিয়েছেন, উন্নত দেশগুলোতেও রাজনীতিবিদরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে মুখোশ পরেন এবং ব্যক্তিগত অপকর্মের প্রকাশ ঠেকাতে সচেষ্ট থাকেন।
লিন্ডা এবং জ্যাকব—উভয়েই সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত অবস্থানে থেকেও ব্যক্তিগত জীবনে কতটা জটিলতা ও দ্বিধাহীনতার শিকার, সেই দিকটি পাওলো কোয়েলহো তাঁর নিজস্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
বই পড়লে গল্প বলা শিখবেন, কিন্ত গল্প বলে অমিত কেন হাসপাতালে।

অনুবাদের মাধ্যমে কাহিনীর গভীরতা
এই উপন্যাসটি বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে (যেমন কবির কল্লোলের অনুবাদ)। যদিও কিছু অনুবাদকের মতে, অনুবাদে আরও যত্নের ছাপ থাকতে পারত, তবুও কাহিনীর গভীরতা এবং জীবনবোধের অনুসন্ধান পাঠককে ধীরে ধীরে এর প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। এটি কেবল একটি পরকীয়ার কাহিনী নয়, বরং এটি লিন্ডার সেই আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প, যেখানে তিনি বুঝতে পারেন—সত্যিকারের সুখ বাইরে নয়, বরং নিজের ভেতরের শূন্যতা পূরণের মধ্যেই নিহিত।
‘অ্যাডাল্টরি’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়: জীবনে সব অর্জন করার পরেও যদি নিজের ভেতরের মানুষটি না বাঁচে, তবে সেই জীবন কেবলই এক বিলাসবহুল খাঁচা। বইটি সফলতার সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
আপনার মানসিক স্বাস্থ্য এবং সম্পর্কের যত্ন নিন।
পরকীয়ায় আক্রান্ত বন্ধুকে পোস্টটি শেয়ার করে দিন। সেলিম হোসেন – তাং ১৩/১০/২০২৪ ইং – ছবিগুলো প্রতীকী









